“কেউ কথা রাখেনি” সুনীল গঙ্গোপাধ্যয়ের অত্যন্ত বিখ্যাত একটি কবিতার শিরোনাম। কথাগুলো বেশ কাব্যিক ধরনের। তবে “কেউ কেউ কথা রাখে” কোন কবিতার বই নয়, বরং একটা চমৎকার থ্রিলার উপন্যাস। লেখক-মোহাম্মদ নাজিমুদ্দিন।
উপন্যাসের সময়টা ১৯৭২। নববিবাহিত এক তরুণীকে (মিলি) ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছে— তদন্তে জড়িয়ে পড়েছেন দুইজন পুলিশ অফিসার, একজন আবার আমাদের লেখক স্বয়ং। মিলির স্বামী মিনহাজের সাথে কথা বলার সময় কিছু ফটোগ্রাম লেখকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ফটোগ্রাফগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে লেখকের সন্দেহ হয় ফটোগ্রাফের একজনের উপর। ছবির ব্যক্তির সম্পর্কে আরো কিছু তথ্য সংগ্রহ করতে লেখক হানা দেন মিলির বান্ধবীর (রামজিয়া শেহ্রিন) বাড়িতে। এই রামজিয়া শেহ্রিন অত্যন্ত আকর্ষণীয় একটি চরিত্র এই গল্পে। প্রথম দিনই রামজিয়ার প্রতি দূর্বল হয়ে পড়েন লেখক। থ্রিলার উপন্যাসে দেখায় দেয় রোমাঞ্চ।
উপন্যাসের আরেকটি অসাধারণ চরিত্র সাব-ইন্সপেক্টর এসএম হায়দার। মুক্তিযোদ্ধা এবং দৃঢ় চরিত্রের এসএম হায়দারই পাঠকের মন কেড়ে নেয় শুরু থেকে। হায়দারের সাথে লেখকের তীব্র বিরোধীতা রাজনীতি নিয়ে। লেখক আওয়ামী লীগ এবং শেখ মুজিবুর রহমানের একনিষ্ঠ ভক্ত, কিন্তু হায়দার শেখ মুজিবুরের রাজনৈতিক আদর্শের ত্রুটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন বার বার। লেখকের চমৎকার তদন্তে এক সময় সকলে জানতে পারেন খুনী ইমতিয়াজ মিলির পরিবারের পুরোনো আত্মীয়। মিলির স্বামী অনুরোধ করে ইমতিয়াজের যেন ফাঁসি না হয়। ইমতিয়াজ যেন সারা জীবন জেলে পঁচে মরে।
এসএম হায়দারের সুনিপুণ দক্ষতা এবং তৎপরতায় এক পর্যায়ে ধরে ফেলেন মিলি’র খুনি ইমতিয়াজকে, কিন্তু রাজনৈতিক নেতার ছত্রছায়ায় থাকা ধর্ষক ও খুনীকে বিচারের কাঠগোড়ায় দাঁড় করাতে ব্যর্থ হন হায়দার। সদ্য স্বাধীন হওয়া একটি দেশে নোংড়া রাজনীতির এই করাল থাবায় শেষ পর্যন্ত খুন হয়ে যান স্বয়ং এসএম হায়দার। ভেঙ্গে পড়েন লেখক। সংগত কারণেই বার বার দেশের রাজনৈতিক অবস্থা, আওয়ামী লীগের তৎকালীন রাজনীতি, শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈদিক দৃষ্টিভঙ্গী ও তৎকালীন সময়ের সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা প্রভৃতির চমৎকার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে উপন্যাসটিতে। হায়দারের মৃত্যুর পর ভেঙ্গে পড়েন লেখক। হায়দারের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে মিলির খুনী ইমতিয়াজও একেবারে নেই হয়ে যায়, কোথাও আর তাকে দেখতে পাওয়া যায় না। এই সময়েই দেশে বড় ধরনের একটা ঘটনা ঘটে যায়, সপরিবারে খুন হন শেখ মুজিবুর রহমান। সেই রাতেই লেখক ঢাকা ছেড়ে গ্রামে ফিরে যান, পেছনে পড়ে যায় তার প্রিয় মানুষটিও। সবকিছু ভুলে গ্রামে এক স্কুল শিক্ষক হিসাবে শুরু করেন নতুন জীবন। ধীরে ধীরে সাহিত্যিক হিসাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন লেখক, আবার ঢাকায় ফিরে আসেন। উপন্যাসের শুরুতে দেখা যায় দুই যুগ পরে লেখক তার উপন্যাসটির একটি চরিত্রের সাথেই দেখা করতে চলেছেন। সেই চরিত্র আবার যে সে নয়, দুইযুগ আগে লেখক মনের কোনে যাকে স্থান দিয়েছিলেন। রামজিয়ার সাথে নতুন করে আলোচনা শুরু হয় দুই যুগ আগের মিলি হত্যাকান্ডের। লেখক খুজে খুজে বের করে মিলির স্বামী মিনহাজকে। সাথে সাথে আবিষ্কার করেন এক অদ্ভুত সত্যেকে। মিনহাজের স্বামী কথা রেখেছে ! ! !
কি সেই কথা? সম্পূর্ণটা জানতে পড়তে হবে বইটি।
উপন্যাসের সমাপ্তিতে পাঠক একটা তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারবেন তবে সমগ্র উপন্যাসের পটভূমি পাঠককে কিছু সময়ের জন্য আছন্ন করে রাখবে—অন্তত আমার তা-ই মনে হয়েছে।
মূলত আর্জেন্টিনার জনপ্রিয় লেখক এদুয়ার্দো সাচেরি’র “লা প্রেহুন্তা দে সুস ওহোস” উপন্যাসের ছায়া অবলম্বনে উপন্যাসটি রচিত। লেখক যদিও স্বীকার করতে কার্পণ্য করেন নি কিন্তু বাংলাদেশের আবহাওয়া এবং কাহিনীতে কিছুটা পরিবর্তন করে লেখক নিজে কিছুটা ক্রেডিট নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তবে আমার মত নগণ্য পাঠক তাতে দোষের কিছু দেখে না।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন