বুধবার, ১৩ মে, ২০২০

বিক্রমাদিত্যের বত্রিশ সিংহাসন


সংস্কৃত ভাষায় মহাকবি কালিদাস রচিত ‘দ্বাত্রিংশৎ পুত্তলিকা’ যা বাংলায় ‘বত্রিশ সিংহাসন’ নামে পরিচিত। এই কাহিনীতে মূলত ৩২টি পুতুলের মাধ্যমে রাজা বিক্রমাদিত্যর চরিত্রের দানশীলতা, ধৈর্য, পরোপকারিতা এবং অবিচল সাহসের পরিচয় ব্যক্ত করা হয়েছে। ‘দ্বাত্রিংশৎ পুত্তলিকা’ কালিদাসের একটি অসাধারণ সাহিত্যকর্ম হলেও নীতিশাস্ত্র হিসাবেই বেশী সমাদৃত। গল্পের মধ্য দিয়ে নীতিশাস্ত্র শিক্ষা দেওয়ার প্রচলন বিশ্বজুড়ে প্রচলিত। ‘দ্বাত্রিংশৎ পুত্তলিকা’ও শিশুশিক্ষামূলক পুস্তক হিসাবে ভারতে বহুল জনপ্রিয়। বত্রিশ সিংহাসনের কথা বলে হলেও আসলে কিন্তু সিংহাসন একটি। এই সিংহাসন বিক্রমাদিত্য পেয়েছিলেন স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্রের কাছ থেকে। দেবরাজ ইন্দ্র বিশ্বমিত্র মুনির তপস্যা ভঙ্গ করার জন্য রম্ভা না উর্ব্বশী, কাকে পাঠাবেন অর্থাৎ দুজনের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ সে বিচারের জন্য বিক্রমাদিত্যকে ডাকলেন স্বর্গে। বিক্রমাদিত্য দুজনের নৃত্য পর্যবেক্ষণ করে শাস্ত্রজ্ঞান দ্বারা উর্বশীকে শ্রেষ্ঠ নির্বাচন করলেন। কৃতজ্ঞতাস্বরূপ দেবরাজ ইন্দ্র বিক্রমাদিত্যকে বত্রিশটি পরী খচিত সিংহাসন উপহার দেন। 

পরবর্তীতে রাজা বিক্রমাদিত্যের মৃত্যু হলে সে সিংহাসন ফেলে দেওয়া হয় এবং বহুবছর পরে ভোজ রাজা সেই সিংহাসন খুজে পান। সিংহাসন খুজেঁ পাওয়ার কাহিনীটিও বেশ চমৎকার। কোন কোন অনুবাদকের কাহিনীতে দেখা যায় ভোজ রাজা একদিন রাজকুমারদের নিয়ে এক কৃষকের মাঠের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখতে পান মাঠের এক পাশে মাটির উচু ঢিবির উপর কৃষক বসে আছেন। রাজাকে দেখার সাথে সাথে কৃষক রাজার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এবং মাঠে প্রবেশ করে ফলমূলাদি আহার করতে অনুরোধ করেন। রাজা তার পুত্রদের নিয়ে যখনই মাঠে প্রবেশ করেন তখন কৃষক ঢিবি থেকে নেমে আসেন এবং রাজাকে এভাবে মাঠে প্রবেশ ও ফল সংগ্রহের জন্য অবিবেচক বলে অভিহিত করেন। রাজা এভাবে একজন প্রজার মাঠে প্রবেশ করেছেন বলে অনুশোচনা করে যখনই মাঠ থেকে বের হয়ে গেলেন। কৃষক তখন আবারো ঢিবির উপর গিয়ে বসলেন। ঢিবির উপর বসার সাথে সাথে কৃষকের মন আবার উদারতায় পূর্ণ হয়ে গেল। তিনি আবার রাজাকে ডেকে বললেন যে, এই রাজ্যের প্রতিটি সম্পদই রাজার, রাজা যেন রাজপুত্রদের নিয়ে অবশ্যই মাঠ থেকে ফলমূল সংগ্রহ করে নিয়ে যান। রাজা আবারো মাঠে প্রবেশ করলেন এবং যখন গাছ থেকে ফল উত্তোলন করছেন তখন আবারো কৃষক নিচে নেমে এসে রাজাকে এভাবে একজন প্রজার মাঠ থেকে ফল সংগ্রহ করার জন্য তিরস্কার করতে শুরু করলেন। রাজা আবার ফিরে যেতে লাগলেন, কৃষক আবারো ঢিবির উপর উঠলেন এবং পুনরায় রাজাকে মাঠে আহ্বান জানালেন। রাজা তখন রীতিমত অবাক হলে এবং বুঝলেন ঢিবিতে কিছু একটা আছে। লোক দিয়ে ঢিবি খুড়ে দেখলেন সেখানে একটি সিংহাসন আছে।
প্রায় একইরকম অন্য একটি কাহিনীতে দেখা যায় কিছু রাখাল বালক এক মাঠে খেলা করতে করতে ঝগড়া-মারামারি শুরু করে এবং ঝগড়া মিটানোর জন্য তাদের মধ্য থেকে নিজেরাই একজন নেতা নির্বাচন করে তাকে মাটির উচু ঢিবিতে বসালো। ঢিবির উপর যাকে বসানো হল তার মধ্যে এক অদ্ভুত বিচারক্ষমতা সৃষ্টি হল এবং সে চমৎকারভাবে তাদের মধ্যকার ঝগড়া মিটিয়ে ফেললো। গ্রামের দুজন মানুষ এই দৃশ্য দেখে তাদের একটি সমস্যার কথা ছেলেটিকে বললেন এবং ছেলেটি সেই সমস্যারও সুন্দর সমাধান বলে দিল। এভাবে ছেলেটির অদ্ভুত বিচার ক্ষমতার কথা চারিদিকে রাষ্ট্র হয়ে গেল। রাজা তখন ছেলেটিকে রাজবাড়িতে ডেকে নিয়ে কিছু বিচারের ভার দিলেন। কিন্তু বালকটি কোন বিচারই সুষ্ঠুভাবে করতে পারল না। পরে ছেলেটি গ্রামে ফিরে ঢিবির উপর বসে আবারো সুন্দর বিচার করতে শুরু করলেন। রাজা কিছু অনুধাবন করে সেই মাটির ঢিবি খুড়লেন এবং বেরিয়ে এল বিক্রমাদিত্যের সেই সিংহাসন।
একটা সুন্দর দিনে রাজা ভোজ তাতে আহরণ করতে গেলে সিংহাসনে খচির বত্রিশ পরীর এক পরী মানুষের মত কথা বলে উঠল এবং রাজাকে জানালো তিনি যদি রাজা বিক্রমাদিত্যের ন্যায় গুণের অধিকারী হন শুধুমাত্র তাহলেই এই সিংহাসনে বসার অধিকার পাবেন। ভোজ রাজা বিক্রমাদিত্যের গুণের কথা জানতে চাইলে একজন একজন করে বিক্রমাদিত্যের মহত্ত্বের কাহিনী বলতে শুরু করে। এভাবে বত্রিশটি পরী বত্রিশটি গল্পের বর্ণনার মধ্য দিয়ে কাহিনীর সমাপ্তি ঘটে। রাজাভোজ বুঝতে পারেন তিনি বিক্রমাদিত্যের মত গুণী নন এবং তার আর বিক্রমাদিত্যের সিংহাসনে বসার সৌভাগ্য হয় না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন