শুন বরনারী-সুবোধ ঘোষ |
‘হিমু’ হুমায়ুন আহমেদের একটি কালজী সৃষ্টি। হিমুর অদ্ভুত জীবনদর্শন,
নানারকম খামখেয়ালীপনা এবং নাটকীয় কার্যকলাপে প্রত্যেক পাঠকই মুগ্ধ হন। তবে ‘হিমু’ চরিত্রটিকে
সম্পূর্ণ মৌলিক বলা যায় না, বিশেষ করে নামটির ব্যপারে তো নয়ই। হুমায়ুন আহমেদ নিজের
আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন ‘হিমু’ নামটি তিনি নিয়েছিলেন কথাসাহিত্যিক সুবোধ ঘোষের
“শুন বরনারী” উপন্যাসের একটি চরিত্র থেকে। হুমায়ুন আহমেদের লেখা থেকেই আমি প্রথম সুবোধ
ঘোষের নাম জানতে পারি এবং ‘শুন বরনারী’ উপন্যাসটি পড়ার আগ্রহ সৃষ্টি হয়।
শুন বরনারী একটি প্রেমের উপন্যাস। নায়কের নাম হিমাদ্রিশেখর
দত্ত (হোমিও) হলেও আশেপাশের সকলে তাকে হোমিও হিমু বা শুধু হিমুদা নামেই ডাকেন। পেশায়
একজন হোমিও ডাক্তার। আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের থেকে একটু আলাদ এই মানুষটি নিঃস্বার্থ
এবং পরোপকারী। গিরিডি’র (ভারতের একটি জায়গার
নাম) একটা সাধারণ বাড়িতে একাকী বসবাস করেন হিমু, প্রতিবেশীর যেকোন
প্রয়োজনে ছুটে যান সাহায্যের হাত বাড়িয়ে। বিশেষ করে গিরিডির কলেজপড়ুয়া মেয়েদেরকে নিরাপদে
তাদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দিতে অভিভাবকদের কাছে হিমুই একমাত্র ভরসা। তবে প্রয়োজনে কাছে
ডাকলেও হিমুকে কেউ তাদের একজন ভাবে না, প্রয়োজন শেষে তাকে ভুলে যায় সবাই। তাই ননীবাবুর
মেয়ের বিয়েতে মহল্লার সকলেই নিমন্ত্রণ পেলেও সকলেই ভুলে যান হিমুর কথা। তবে হিমুর তা
নিয়ে কোন দুঃখ নেই। হিমুর এমন নির্লিপ্ত আচরণ পাঠকের কাছে তাকে কিছুটা বাক্তিত্বহীন
করে তোলে এবং স্বাভাবিক ভাবেই পাঠক হিমুর জন্য কষ্ট অনুভব করেন।
কিন্তু হিমুর মধ্যেও যে একটা গভীর ব্যক্তিত্ববোধ
আছে সেটা অবাক হয়ে পাঠক আবিষ্কার করে যখন উদাসীনের (বাড়ীর নাম) উকিল চারু ঘোষের একমাত্র মেয়ে যূথিকা ঘোষকে পাটনা পাঠানোর জন্য ডাক পড়ল হিমুর। চারু ঘোষ অত্যন্ত বাস্তববাদী মানুষ, তিনি একটি কঠোর প্রতিজ্ঞা
বাস্তবায়ন করে চলেছেন—কাউকে উপকার বা অপকার করবেন না, নিজেও কারো কাছ থেকে উপকার নেবেন
না বা অপকার করার সুযোগ দেবেন না। যূথিকাকে পাটনায় পৌছে দেওয়ার জন্য যখন তিনি হিমুকে
পারিশ্রমিক দেওয়ার কথা জানালেন তখন তা হিমুর আত্মসম্মানে লাগল এবং স্পষ্টভাবেই জানালেন
টাকার বিনিময়ে তিনি এই ধরনের কাজগুলো করেন না। পরে যূথিকা স্বয়ং হিমুকে অনুরোধ করেন
তাকে পাটনায় নিয়ে যেতে এবং তখন হিমাদ্রি না করতে পারেন না। আর ঠিক
এই জায়গা থেকেই হিমাদ্রিশেখর দত্ত ওরফে হিমুর জীবনের এক নতুন অধ্যায় শুরু হলো। ট্রেনের
ভিতর যূথিকা হিমুকে যতই নিচু প্রকৃতির একজন মানুষ হিসেবে আবিষ্কার করার চেষ্টা করতে
থেকেন ততই তিনি পরিচিত হতে থাকেন হিমুর কর্তব্যপরায়ণতা, হিমুর ব্যক্তিত্ববোধ, হিমুর
সুক্ষ্ম অনুভূতির সাথে। যূথিকার পাটনায় যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল নরেনের সাথে দেখা করা এবং
তাকে জয় করা। কিন্তু ক্রমেই তিনি হিমুর কাছেই পরাজিত হতে থাকেন। পাটনা থেকে ফিরে যুথিকা
বংশ আভিজাত্যের গর্বে যার পা মাটিতে পড়ে না সেই কিনা ছোট দুটি ভাইকে সাথে নিয়ে জীবনে
প্রথম বারের মত পায়ে হেঁটে গিরিডির পথে পথে হিমুকে খুঁজে বেড়ান। শুধু তাই নয় যূথিকার
চরিত্রে আসে কিছু অভাবনীয় পরিবর্তন সে তার জন্মদিনে চাকর, মালী আর ড্রাইভারকে নিজে
হাতে খাবার খাওয়ানোর উদ্যোগও নেয় যা ছিল উদাসীনের রীতিনীতির পরিপন্থী। নিজেকে ভাঙা-গড়ার
মধ্য দিয়ে যূথিকা আবিষ্কার করার চেষ্টা করে সে আসলে কি চায়।
নরেনের সাথে যখন যূথিকার বিয়ের সবকিছু
প্রায় ঠিক তখনই আরোও একবার তার পাটনা যাওয়ার-আসার সঙ্গী হতে হয় হিমুকে। এবং এবারই যূথিকা
হিমাদ্রীকে জানিয়ে দেয় নরেনকে সে বিয়ে করবে না, সে ভালোবাসে হিমুকে। হিমুও স্বীকার
করেন যূথিকার প্রতি তার দূর্বলতার কথা। হিমাদ্রী রাজী হন যূথিকাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে।
সামাজিক মর্যাদা ভেঙ্গে নতুন পৃথবী গড়ার স্বপ্নে দুজন মানব-মানবীর
জীবন হয়ে উঠলো মাহাত্ম্যপূর্ণ। কিন্তু বাড়ি ফিরে নিজের ঘরে বসে হিমাদ্রীর পাশে
নিজেকে বসিয়ে আজন্ম আভজাত্যে লালিত যূথিকা বুঝতে পারে কি ভুল সে করে ফেলেছে। যূথিকা
সংশোধনের পথ খুঁজে খুঁজে যখন মরিয়া ততক্ষণে হিমু হারিয়ে গেছেন কোন অজানায়। কেননা হিমু
বুঝতে পেরেছিলেন যূথিকার কৃতকর্মের মধ্যে আছে শুধুই বাঁধভাঙ্গা আবেগ, বাস্তবতার রূঢ়
ছেনির আঘাতে যা মুহূর্তের মধ্যেই ভেঙ্গে মিশে যাবে ধুলিরকণার সাথে।
যদিও হুমায়ুন আহমেদের হিমু এবং সুবোধ
ঘোষের হিমুর মধ্যে অনেক পার্থক্য তারপরেও কিছু সূক্ষ্ম মিল আমার চোখে ধরা পড়ে যেমনঃ
নিঃস্বার্থ পরোপকার ছাড়াও দুজনেই নিজেদের প্রখর বুদ্ধিমত্তাকে চমৎকার ছদ্মবেশের আড়ালে
লুকিয়ে রাখতে ভালোবাসেন। দুজনেই সূক্ষ্মভাবে ভালোবাসার বন্ধন থেকে সবসময় নিজেকে মুক্ত
রেখেছেন এবং দুজনের মধ্যে পাওয়া যায় গভীর নির্লিপ্ততা। তবে একথা বলার কোন অপেক্ষা রাখে
না যে, হুমায়ুন আহমেদ হিমুকে আপন মনের মাধুরী দিয়ে এমন অনন্যভাবে গড়ে তুলেছেন যে, হিমু
স্বমহিমায় উজ্জ্বল। বাংলা সাহিত্যের মহাকাশে হিমুর উজ্জ্বল্য কখনই ম্লান হবে না বরং
আগামী প্রজন্ম হয়তো আরো বেশিই হিমু হতে চাইবে।
সর্বশেষ বলতে চাই, সুবোধ
ঘোষ তার জাদুকরী লেখনী দ্বারা উপন্যাসটি দারুণ উপভোগ্য
করে তুলেছেন।
চাইলে বইটি ডাউনলোড করে পড়ে দেখতে পারেন এখান থেকে।
চলচিত্রের সাথে মূল বইয়েরর কাহিনী বেশ পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।
উত্তরমুছুন