ভূমিকা:
মানুষ আশা-আকাঙ্ক্ষা,
স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে থাকে। শৈশব-কৈশোরে মনের মধ্যে যেসব
স্বপ্নের বীজ প্রোথিত হয়, তার সবই
জীবনে বাস্তবায়িত হয় না। সকলের জীবনেই সমানভাবে সাফল্য আসে না; কারও জীবন
কানায় কানায় পূর্ণতা পায় আর কারও জীবনে কোন
স্বপ্ন-আশা-আকাঙ্ক্ষার আংশিক প্রতিফলন ঘটে। তারপরও প্রত্যেক মানুষেরই নিজের জীবন
সম্পর্কে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকা দরকার। সমুদ্রের বিশাল জলরাশির মধ্যে নাবিক যেমন
ধ্রুব-নক্ষত্রকে লক্ষ্য করে উত্তাল জলরাশি পাড়ি দেয়; তেমনি
মানবজীবনের শৈশবেই লক্ষ্য স্থির করে নিয়ে জীবন নামের এ মহাসমুদ্র পাড়ি দিতে হয়।
প্রত্যেক মানুষের উচিত শৈশবেই নিজের জীবনের লক্ষ্য স্থির করে নিয়ে সংসার-সমুদ্র
পাড়ি দেয়া।
জীবনে
লক্ষ্যস্থির করার গুরুত্ব: জীবনে সাফল্য ও সার্থকতা লাভ করতে
হলে দৃঢ়প্রতিজ্ঞা, সংকল্প
থাকতে হয় । শৈশব-কৈশোরে মানবজীবনের জমিতে যে বীজ বপন করা হয়, তাই পরবর্তী
জীবনের পাথেয়। এজন্যে জীবনের যথাসময়ে সঠিক বীজ বপন করার পাশাপাশি আনুষঙ্গিক
পরিশ্রমের মাধ্যমে সেই বীজ থেকে অঙ্কুরিত চারাকে মহীরুহে পরিণত করতে হয়। জীবনের
লক্ষ্য, উদ্দেশ্যকে
সফল করে তুলতে হলে প্রয়োজন। সাধনার, একনিষ্ঠ
শ্রমের। ইংরেজি একটি প্রবাদে আছে-An aimless life is like a boat without a rudder.' এজন্যেই
মানবজীবনে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নের জন্যে পরিকল্পিত প্রয়াস প্রয়োজন। এ পরিকল্পনাই মানুষকে তার কাঙ্ক্ষিত সাফল্যে পৌছে দেবে। এজন্যে জীবনের
সূচনালগ্নেই প্রত্যেকেরই উচিত জীবনের লক্ষ্য কী হবে, তা স্থির
করা।
লক্ষ্যস্থিরের
উপযুক্ত সময়: মানুষের ছাত্রজীবন হচ্ছে পরিণত তথা পরবর্তী জীবনের
প্রস্তুতিপর্ব। ছাত্রজীবনের স্বপ্ন, কল্পনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা
পরবর্তী জীবনে ফুলে-ফলে সুশোভিত হয়ে ওঠে। তবে এ স্বপ্ন, কল্পনা
অবাস্তব ও উদ্ভট হলে তার ফলাফল অনুরূপ হতাশাব্যঞ্জক হবে; এজন্যে
পরিণত জীবনের জন্যে দরকার লক্ষ্যবাহী উদ্দেশ্য। ছাত্রাবস্থায় লক্ষ্যস্থির করে সেই
লক্ষ্যকে বাস্তবায়নের জন্যে প্রয়োজনীয় শ্রম, নিষ্ঠা, সাধনায়
ব্যক্তি নিয়োজিত থাকলে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে সে একদিন
পৌছাবেই।
প্রত্যেক মানুষের কর্মজীবন
ভিন্ন ভিন্ন ও বিচিত্রমুখী। জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাধনা, চিকিৎসা সেবা দান, শিল্প-কলকারখানা
স্থাপন, ব্যবসা-বাণিজ্য
ইত্যাদি নানামুখী কর্মের মাধ্যমে ব্যক্তি নিজের জীবনে সাফল্য অর্জনের পাশাপাশি
দেশের ও সমাজের কল্যাণ করতে পারে। পেশা হিসেবে লক্ষ্যানুসারে ব্যক্তি-মানুষ বেছে
নিতে পারে চাকরি, আইন-ব্যবসা, প্রকৌশল, ডাক্তারি, কৃষি-উন্নয়ন
প্রভৃতি। কেউ বেছে নিতে পারে শিক্ষকতার মতো মহান। পেশা। তবে এ
পেশাবৃত্তি নির্বাচনের ক্ষেত্রে শারীরিক সামর্থ্য, শিক্ষাগত যোগ্যতা,
আর্থিক সচ্ছলতা ও উপযুক্ত পরিবেশ প্রয়োজন হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পেশাবৃত্তি নির্বাচনের ক্ষেত্রে
সুনির্ধারিত পাঠ্যক্রম অনুসরণ করতে হয়। এজন্যেই জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করে সেই
অনুযায়ী নিজেকে প্রস্তুত করে তোলার প্রয়াস, সাধনা, পরিশ্রম
করতে হয়।
আমার জীবনের
লক্ষ্য: আমার জীবনের লক্ষ্য- আমি একজন সুদক্ষ কৃষক হব। এ নির্বাচন
করায় হয়তাে আমাকে কেউ কেউ উপহাস করতে পারে। কিন্তু আমার জীবনের স্থির লক্ষ্য
একজন আদর্শ কৃষক হওয়া। কেউ কেউ আমার এ লক্ষ্যকে দীন-হীন, সামান্য মনে
করতে পারে । কিন্তু একথা আমাদের মনে রাখতে হবে, কৃষি-উন্নয়নের সঙ্গে দেশ-জাতির
উন্নয়ন নির্ভরশীল। আমি কৃষক হওয়া অর্থে আমাদের দেশের মান্ধাতার আমলের কৃষকের কথা
বলি নি; বরং
আমি আধুনিক যুগের শিক্ষিত,
সুদক্ষ, বিজ্ঞাননির্ভর
প্রগতিশীল কৃষক হতে চাই। আমাদের কৃষিক্ষেত্রে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও বৈজ্ঞানিক সুযোগ-সুবিধার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে এদেশ সত্যিকার অর্থে সোনার বাংলায় পরিণত হবে। কেননা এদেশের মাটির মতো
পৃথিবীর আর কোনো দেশের মাটি উর্বর নয়। বিশ্বের অন্যান্য
অনেক দেশ কৃষিক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে তাদের অর্থনীতিকে সুদৃঢ়
ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়েছে। বাংলাদেশেও যদি কৃষিক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক সুযোগ-সুবিধা ও আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতির সঠিক প্রয়োগ করা
যায়, তাহলে
আমাদের কৃষিনির্ভর দেশের অর্থনীতিও চাঙ্গা হবে। আমি এজন্যেই আমাদের কৃষিক্ষেত্রে
আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষি-বিপ্লব ঘটাতে চাই। আদর্শ কৃষি-খামার
গড়ে তুলে আমাদের পিছিয়ে পড়া কৃষকদের উৎসাহিত করতে চাই আধুনিক চাষাবাদে। একজন
আদর্শ ও দক্ষ কৃষক হয়ে আমি আমার দেশের শতকরা আশি ভাগ মানুষ যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির সাথে যুক্ত; তাদেরকে দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে
মুক্ত করতে চাই।
লক্ষ্যস্থির
করার কারণ: আমার পরিচিত বন্ধু-বান্ধবদের প্রায় সকলেই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, প্রশাসক, অর্থনীতিবিদ
হয়ে শহরে থেকে যেতে চায়। অর্থাৎ চাকরি-ই তাদের জীবনের অন্যতম লক্ষ্য। এদেশের
শিক্ষিত সমাজে বা ছাত্রসমাজে চাকরি-প্রিয়তা এতটা বৃদ্ধি পেয়েছে যে, কেউই গ্রমোন্নয়নের কথা ভাবে না; কিংবা পড়া-লেখা শেষে গ্রামে ফিরে
যেতে চায় না। এর ফলে এত অধিক সংখ্যক শিক্ষিত যুবকের কর্মসংস্থান করতে গিয়ে সরকার
হিমশিম খাচ্ছে; অন্যদিকে
গ্রামবিমুখতার ফলে আমাদের কৃষি পিছিয়েই থাকছে। অথচ কৃষি এদেশের অর্থনীতির মূল
চাবিকাঠি।
আমরা শিক্ষিত হয়েও বুঝতে
পারছি না যে, যে
কৃষি আমাদের জীবিকার আয়োজন করে; তার
পরিচালনার ভার নিরক্ষর,
রুগ্ন, পরিবর্তনবিমুখ, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর হাতে রয়েছে। এদের পক্ষে কৃষি-বিপ্লব ঘটানো কখনোই সম্ভব হবে না যদি আমরা, শিক্ষিতরা এদের সাহায্য-সহযোগিতা না করি। সুতরাং দেশের অর্থনীতির মূল উৎসকে পরিবর্তনবিমুখ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর হাতে ছেড়ে দিয়ে আমরা নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকতে পারি না। এজন্যেই
আমি একজন সুদক্ষ কৃষক হওয়াকে জীবনের লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করেছি। কবিগুরুর
আহ্বান— ‘ফিরে চল ফিরে চল মাটির টানে। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে আমি কৃষক হওয়ার
লক্ষ্যে গ্রামেই ফিরে যাব।
লক্ষ্যের
সার্থকতা: আমি নতুন উদ্যম ও আমার আধুনিক শিক্ষা নিয়ে আমাদের
হতাশাক্লিষ্ট কৃষকদের পাশে দাঁড়াতে চাই। আমাদের কৃষক আজও কৃষিক্ষেত্রে উন্নত
সার-ঔষধ ব্যবহারে অজ্ঞ,
উন্নত বীজ সংগ্রহে তাদের উদাসীনতার ফলে কৃষি ফলন বাড়ছে না। আমাদের কৃষকরা
অশিক্ষার অন্ধকার, কুসংস্কারের
আনুগত্য ও রোগ-মহামারির অভিশাপে নিমজ্জিত। এ কৃষকদের
উন্নয়ন ব্যতিরেকে সামগ্রিকভাবে কৃষিক্ষেত্রের উন্নয়ন সম্ভব হবে না। তাই আমি আমার
সাধ্যানুযায়ী কৃষিক্ষেত্রের আধুনিকায়ন ও কৃষি-সেবার মাধ্যমে যতটুকু সম্ভব
দেশসেবাকে ব্রত হিসেবে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যদি কোনো দিন এদেশের কৃষিতে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগে এবং কৃষি-বিপ্লব সংঘটনের
মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড়ায় তাহলেই আমার জীবনের স্বপ্ন ও
লক্ষ্য সার্থক হবে।
উপসংহার: কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কৃষিসাধনাই দেশের সমৃদ্ধির মূল চাবিকাঠি।
এদেশের কৃষিক্ষেত্রের প্রয়োজনীয়
আধুনিকায়ন করা হলে সকল উন্নয়নের রুদ্ধ দুয়ার খুলে যাবে। আমার বিশ্বাস আমার
একনিষ্ঠ শ্রম, একাগ্র সাধনা, প্রয়াস-প্রচেষ্টা
কৃষি-উন্নয়নের ক্ষেত্রে অব্যাহত থাকবে। এর ফল হিসেবে আমাদের দেশে হয়ত সত্যিই
একদিন কৃষি-বিপ্লব ঘটবে; তবে এজন্যে আমার মতো আরও শিক্ষিত মানুষকে কৃষিউন্নয়নের জন্যে কৃষক হওয়ার ব্রত
গ্রহণ করতে হবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন