এই গল্পটি অনেকেই ছোটবেলায় পড়েছেন। গল্পটি জীবনে চলার পথে একটি চমৎকার দিক নির্দেশনা বলেই আমার মনে হয়, তাই সকলের জন্য শেয়ার করলাম।
এক রাজবাড়ীর সামনে একটি খাঁচায় একটি দুষ্টু বাঘ বন্ধী অবস্থায় ছিল। বাঘটি ছিল খুব দুষ্টু আর হিংসুটে। কেউ তাকে পছন্দ করত না। একদিন রাজার মেয়ের বিয়েতে রাজবাড়িতে অনেক লোকের সমাগম হল। সকলে যখন রাজবারীতে প্রবেশ করছিলেন দুষ্টু বাঘ সবাইকে অনুনয়-বিনয় করছিলেন তার খাঁচার দরজাটা খুলে দেওয়ার জন্য। কিন্তু কেউই বাঘের খাঁচার দরজা খুলে দিলেন না, কেননা সকলে জানতেন এই ভয়ংকর বিপদজঙ্ক বাঘের খাঁচার দরজা খুলে দিলে মহাবিপদ। আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে ছিলেন একজন সহজ সরল ব্রাহ্মণ। ব্রাহ্মণ যখন খাঁচার দরজা দিয়ে যাচ্ছিলেন তখন বাঘ হাতজোড় করে ব্রাহ্মণকে বললেন, “আমাকে দয়া করুন প্রভু, আমাকে দয়া করুন। আমার খাঁচার দরজাটা অনুগ্রহ করে খুলে দিন। আমি বনের বাঘ বনে চলে যাবো।”
ব্রাহ্মণ একটু চিন্তা করলেন। বাঘ তখন কেঁদেই ফেলল এবং নানাভাবে ব্রাহ্মণের কাছে অনুনয় প্রকাশ করতে লাগল। এর ফলে ব্রাহ্মণের হৃদয় গলে গেল। তিনি খাঁচার দরজা খুলে দিলেন।
দুষ্টু বাঘ খাঁচা থেকে বের হয়ে এসেই ব্রাহ্মণের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্যোত হলেন। ব্রাহ্মণ তখন বাঘকে নিরস্ত করে বললেন, “এটা কেমন হল? আমি তোমার এতবড় উপকার করলাম, আর তুমি আমাকে খেঁয়ে তার প্রতিদান দেবে? এমনটা কেউ কখনও করে?”
বাঘ নিষ্ঠুর হাসি হেসে বলল, “সেটাই তো সকলে করে? তুমি চাইলে সাক্ষী মানতে পারো।”
ব্রাহ্মণ তখন বললেন, “ঠিক আছে, আমি তিনজনকে সাক্ষী মানতে চাই, যদি তিনজনের একজনও আমার পক্ষে বলে তাহলে তুমি আমাকে ছেড়ে দেবে।” বাঘ সেই প্রস্তাবে সম্মত হল। এরপর দুজনে মিলে মাঠের ভিতর দিয়ে হাটতে শুরু করলেন। কিছুদূর এগিয়ে ব্রাহ্মণটি জমির আইল দেখে বললেন, “এই জমির আইল-ই আমার প্রথম সাক্ষী।” বাঘ তখন বললেন, “ঠিক আছে, আপনি এর কাছে জিজ্ঞেস করুন।”
ব্রাহ্মণ তখন আইলের কাছে প্রশ্ন করলেন, “আচ্ছা, উপকার যে করে, অপকার কি তার কেউ কখনও করে?”
আইল উত্তর দিলেন, “হ্যা, তাই তো সকলে করে, এই আমাকেই দেখুন না। আমি দুই জমির মধ্যে সীমানা নির্ধারণ করি। এতে মানুষের কত উপকার হয়, অথচ সেই মানুষেরা আমাকে ক্ষত-বিক্ষত করে। ইত্যাদি ইত্যাদি।”
বাঘ উত্তর শুনে মুচকি হাসলো, ব্রাহ্মণের মুখ শুকিয়ে গেল। ব্রাহ্মণ আর বাঘ আরো একটু এগিয়ে গিয়ে একটি বড় গাছ দেখতে পেল। ব্রাহ্মণ তখন সেই গাছকে সাক্ষী মানলেন। ব্রাহ্মণের প্রশ্নের জবাবে গাছ বলল, “আমার ছায়ায় এসে মানুষ বসে, আমার ফল খেয়ে ক্ষুধা মিটায় আবার আমারই ডাল ভেঙ্গে আমার ক্ষতি করে। এমনি কি আমার বাকল ছিড়ে আঁঠা বের করে নিয়ে যায়। সুতরাং উপকারীর অপকারই সকলে করে।”
বাঘ বলল, “এবার আমি তোমাকে খেয়ে ফেলব।”
ব্রাহ্মণ শুখনো গলায় বললেন, “আরো একজন সাক্ষী বাকী আছে।” বাঘ ক্রুর হাসি হেসে বললেন, “যাকেই সাক্ষী মানবে সে-ই আমার পক্ষে বলবে।” এমন সময় দূর দিয়ে একটি শিয়াল যাচ্ছিল। ব্রাহ্মণ তখন শিয়ালকে সাক্ষী মানলেন এবং শিয়ালকে ডেকে বললেন, “ও ভাই শিয়াল, বলো তো, উপকার যে করে, অপকার কি তার কেউ কখনও করে?”
শিঁয়াল দাঁড়িয়ে আড়চোখে তাকিয়ে বুঝল কিছু একটা গোলমাল আছে। সে দূর থেকেই বলল, “কে কার কি উপকার করল সে সব না জেনে, বুঝে কিভাবে বলব?”
তখন ব্রাহ্মণ চিৎকার করে বললেন, “এই বাঘ ছিলো, খাঁচার ভিতরে, আমি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম।” শিয়ালও চিৎকার করে বলল, “কোথায় খাঁচা আর কোথায় রাস্তা, সেখানে না গেলে আমি কিছুই বলতে পারব না।”
তিনজন মিলে তখন সেই খাঁচার নিকট গেলেন। ব্রাহ্মণ শিয়ালকে বললেন, “বাঘ ছিলো এই খাঁচার ভিতর, আমি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম।” শিঁয়াল ব্রাহ্মণকে থামিয়ে বলল, “দাঁড়ান, দাঁড়ান, আপনি ছিলেন খাঁচার ভিতরে, আর বাঘ ছিল রাস্তায়?”
ব্রাহ্মণ বললেন, “না-না, আমি ছিলাম রাস্তায়, আর বাঘ ছিলো খাঁচার ভিতরে।” শিয়াল তখন আবারো না বোঝার ভান করে বলল, “ও বুঝেছি, রাস্তা ছিল খাঁচার ভিতরে, আর বাঘ ছিল রাস্তার ভিতরে, তাই তো?”
বাঘ তখন রেগে-মেগে বললো, “তুই তো দেখছি আচ্ছা বোকা, এই দেখ, আমি ছিলাম খাঁচার ভিতরে, আর ব্রাহ্মণ ছিলেন রাস্তায়।” এই বলে বাঘ এক লাফে খাঁচার ভিতরে গিয়ে দাঁড়াল। শিঁয়াল সঙ্গে সঙ্গে খাঁচার দরজা বন্ধ করে দিয়ে বললো, “আর এভাবে খাঁচার দরজা বন্ধ ছিল, তাইতো?” বাঘ বলল, “হ্যা, বোকা শিঁয়াল, এবার দরজা খোল, আমি ব্রাহ্মণকে খেঁয়ে ফেলব।”
শিঁয়াল খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে বললো, “সে আর হচ্ছে না, এই ব্রাহ্মণ তোমাকে উপকার করেছিল, আর তুমি তাকে খেঁয়ে ফেলতে চেয়েছিলে, তোমার মত দুষ্টু বাঘের কখনই উপকার করা উচিত নয়।” এরপর শিঁয়াল ব্রাহ্মণকে বললেন, “এখুনি পালান আর কখনই দুষ্টু বাঘের উপকার করবেন না।”
সারকথাঃ জীবনে চলার পথে সবসময় সহজ-সরলভাবে চলতে বিপদে পড়তে হয়। নিজেকে বিপন্ন করে কাউকে উপকার করতে যেতে নেই, তাহলে দূর্গতীর সীমা থাকে না।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন