ভূমিকা:
সাফল্য লাভের জন্যে প্রয়োজন সাধনা। সাধনার পথে থাকতে পারে পর্বত
পরিমাণ বাধা। বাধা অতিক্রম কৌশলে ভুল হতে পারে বার বার। তাই চেষ্টা চালিয়ে যেতে
হবে বহুবার, কারণ
মানুষেরই ভুল হয়। ভুল থেকেই মানুষের জীবনে নেমে আসে ব্যর্থতা। সমস্ত ভুলকে শুধরিয়ে
সাফল্য লাভের জন্যে ধৈর্য,
পরিশ্রম ও নিষ্ঠাসহকারে বারবার চেষ্টা বা সংগ্রাম করার নামই অধ্যবসায়।
অধ্যবসায় হচ্ছে মানুষের অন্যতম মানবীয় গুণ। অধ্যবসায়ের বলেই মানুষ পৃথিবী থেকে
‘অসম্ভব' কথাটি
বিতাড়িত করেছে।
অধ্যবসায়ের
প্রয়োজনীয়তা: অধ্যবসায়
মানবজীবনের সংগ্রামের মৌল প্রেরণা। সংগ্রামে জয় আছে, আছে পরাজয়।
কিন্তু পরাজয়ই শেষ কথা নয়, পরাজয় হচ্ছে নতুনতর জয়ের পথিকৃৎ। অতএব ‘ধৈর্য ধরো, ধৈর্য ধরো, বাঁধো বাঁধো বুক। বারবার চেষ্টার ফলেই মানুষের ভাগ্যাকাশে
ওঠে সাফল্যের ধ্রুবতারা। জীবনের ব্যর্থতাই সাফল্যের সোপান। “Failure is the pillar of success”.
অধ্যবসায়ের গুণেই মানুষ বড় হয়, অসাধ্য সাধন করতে পারে। জগতে বড় বড়
শিল্পী, সাহিত্যিক, বৈজ্ঞানিক, সেনানায়ক, ধর্মপ্রবর্তক
সবাই ছিলেন অধ্যবসায়ী। তাই মানবজীবনের প্রতিটি স্তরে অধ্যবসায়ের ভূমিকা
অনস্বীকার্য। ছাত্রজীবনেও সফলতা অর্জনে অধ্যবসায়ের মূল্য অপরিসীম। গভীর
আত্মপ্রত্যয়ে অবিরাম অনুশীলন করলে দুরূহ বিষয়ও আয়ত্তে এসে যায়। এরকম প্রতিটি
ক্ষেত্রেই অবিচল অধ্যবসায় মানুষকে সাফল্যের স্বর্ণশিখরে পৌছে দেয়। অধ্যবসায় ও
প্রতিভা: অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী না হলে বড় কাজ সাধন করা যায় না- এমন ধারণা পোষণ করা মোটেও উচিত নয়। কারণ, অধ্যবসায় ও
পরিশ্রম ব্যতীত শুধু প্রতিভায় কাজ হয় না। জগতে বহু বিখ্যাত লোক জন্মেছে যারা প্রতিভাবান অপেক্ষা অধ্যবসায়ীই ছিলেন বেশি। ভলতেয়ার
বলেছেন, প্রতিভা
বলে কিছু নেই। পরিশ্রম ও সাধনা করে যাও। তাহলে প্রতিভাকে অগ্রাহ্য করতে পারবে।'
মানবজীবনে
অধ্যবসায়: অধ্যবসায় মানব চরিত্রের এক মহতী শক্তি। মানবসভ্যতার সেই
অস্ফুট মুহর্ত থেকে যে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল, আজও তার শেষ হয় নি। এ সংগ্রামই
মানুষের অভিজ্ঞানপত্র। জীবন-যুদ্ধে জয়লাভ করতে হলে প্রয়োজন সাহস ও অধ্যবসায়। এ শক্তিই মানুষের এক মহৎ চারিত্রিক লক্ষণ।
দুর্বলচিত্তের মানুষ কখনও অধ্যবসায়ী হতে পারে না। কারণে-অকারণে সামান্য প্রতিকূল
আঘাতেই তার ধৈর্যচ্যুতি ঘটে। যারা দৃঢ়চিত্ত, অধ্যবসায় তাদের চরিত্রের এক মহৎ
মানবিক গুণ। শান্তচিত্তে প্রতিকূলতাকে জয় করার মূলে আছে অধ্যবসায়। অন্য মানবিক
সৎ গুণের মতোই জীবনে অধ্যবসায়েরও সযত্নে লালন, পরিচর্যা
প্রয়োজন। নিরন্তর অনুশীলনেই এ বৃত্তির বিকাশ সাধিত হয়।
ছাত্রজীবনে
অধ্যবসায়: ছাত্রজীবনে অধ্যবসায়ের প্রয়োজন সর্বাধিক।
ছাত্ররা সমাজের ভাবী গৌরবকেতন। বিশ্বের কোটি কোটি বতি ভাগ্যহত মানুষ তাদের দিকে
তাকিয়ে আছে। অধ্যবসায়ী ছাত্র অল্প মেধাশক্তিসম্পন্ন হলেও সাফল্য লাভ করতে পারে।
কাজেই অকৃতকার্য ছাত্র-ছাত্রীদের হতাশ না হয়ে পুনরায় দ্বিগুণ উৎসাহে অধ্যয়নে
মনােনিবেশ করা উচিত। কারণ অধ্যবসায়ই পারে ব্যর্থতার গ্লানি মুছে দিয়ে সাফল্যের পথ
দেখাতে। ছাত্রজীবনে অধ্যবসায়ের গুরুত্ব তুলে ধরে কবি বলে গেছেন—
‘পারিব না এ
কথাটি বলিও না আর,
কেন পারিবে
না তাহা ভাবো একবার।
পাঁচজনে
পারে যাহা, তুমিও
পারিবে তাহা
পারো কি না পারো করো যতন আবার।
একবার না
পারিলে দেখ শতবার।
বিজ্ঞানের
ক্ষেত্রে অধ্যবসায়: পৃথিবীর প্রতিটি বৈজ্ঞানিকের আবিষ্কারের পশ্চাতে
রয়েছে অধ্যবসায়ের উজ্জ্বল ভূমিকা। মানুষ বিদ্যুৎ আবিষ্কার করে দূর করেছে আঁধার, বিমান
আবিষ্কার করে জয় করেছে আকাশ, রকেটের সাহায্যে অর্জন করেছে চন্দ্রবিজয়ের গৌরব। আর এসব
সাফল্যের পেছনে কাজ করেছে মানুষের যুগ-যুগান্তরের সাধনা— তার অবিরাম অধ্যবসায়।
অধ্যবসায়ের
দৃষ্টান্ত: ধৈর্যশীল ও অধ্যবসায়ী ব্যক্তিরাই মানবজন্মকে সার্থক করে তোলেন। অনেক বাধা-বিপত্তির মধ্য দিয়েই মনীষীরা কর্মের পথে এগিয়ে গেছেন
অবিচল নিষ্ঠায়। তাদের জীবনের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে কত কালবৈশাখী ঝড়। তারা জীবনে
পেয়েছেন কত লাঞ্ছনা। সবলের রক্তচক্ষু শাসনেও তারা অকুতোভয়, নির্ভীক।
ত্যাগ, ধৈর্যে
তাঁরা মানুষের কাছে তুলে দিয়েছেন অমৃতের পাত্র। নিজেরা পান করেছেন জীবন মন্থনের
গরল। সেই নীলকণ্ঠ মহামানবের পুণ্যস্পর্শ সাধারণ মানুষের জীবন ধন্য হয়েছে। রাজার
দুলাল গৌতম বুদ্ধও একদিন জীবনের সত্য সন্ধান করতে গিয়ে সুখের স্বর্ণসিংহাসন থেকে
নেমে এলেন পথের ধুলোয়। সেদিনও কি কপিলাবস্তুর রাজপুরীতে কম
ঝড় উঠেছিল? প্রতিকূলতাকে
তিনি জয় করেছিলেন অসীম ত্যাগ আর তিতিক্ষায়। অধ্যবসায়ই ছিল তাঁর সেদিনের মন্ত্র।
এলেন মহানবী হযরত মুহম্মদ (স)। সেদিন এ মুক্তিমন্ত্রে উজ্জীবিত মহাপুরুষের জীবনেও
কি দুঃখ-কষ্টের আঘাত কম ছিল? সহনশীলতা মানুষের জীবনকে যে কী পরিমাণে সত্যের আলােকে
উদ্ভাসিত করতে পারে,
এঁদের জীবনই তার প্রমাণ। করুণা-সাগর বিদ্যাসাগরের সমুন্নত মহিমা, সহিষ্ণুতার
আদর্শেই প্রাণোজ্জ্বল। এছাড়া সাহিত্য-শিল্প-বিজ্ঞান
সাধনায়ও মানুষের অধ্যবসায়ের তুলনা নেই। ম্যাক্সিম গোর্কি, ডস্টয়েভাস্কি
জীবনে কি কম দুঃখ পেয়েছিলেন? রবীন্দ্রনাথও কি কম নিন্দা-সমালোচনার শরবাণে জর্জরিত হয়েছিলেন? চরম দারিদ্র্য হতাশার মধ্যেও কত
কবি-সাহিত্যিক সুন্দরের আরাধনা করে গেছেন। এমনি কত বিজ্ঞানীকেও বারবার অধ্যবসায়ের
অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয়েছে। বিজ্ঞানী গ্যালিলিও, মাইকেল ফ্যারাডে, লুই পাস্তুর, মাদামকুরী, নিউটন, আইনস্টাইন
এঁদের জীবনেও এসেছে কত প্রতিকূলতার আঘাত। মাইকেল এঞ্জেলো, লিওনার্দো
দ্যা ভিঞ্চির মতো শিল্পীর জীবনও নানা ঘাত-প্রতিঘাতে হয়েছে
সংক্ষুব্ধ। অধ্যবসায়ের প্রদীপ্ত আদর্শই ছিল তাদের সৃষ্টির প্রেরণা। যুগে যুগে
অভিযাত্রীরাও মৃত্যুর ভূকুটি উপেক্ষা করে আবিষ্কার করেছেন নতুন নতুন দেশ। দুর্গম
পর্বত শিখরে রেখে এসেছেন জয়ের নিশান। অধ্যবসায়ী ছিলেন বলেই সম্রাট নেপোলিয়ান এমন দৃঢ়কণ্ঠে বলতে পেরেছিলেন, ‘অসম্ভব
শব্দটি কেবল নির্বোধের অভিধানেই পাওয়া যায়। স্কটল্যান্ডের রাজা রবার্ট ব্রুস
অধ্যবসায়ের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। ইংরেজদের সঙ্গে পরপর ছ বার যুদ্ধে
পরাজিত হয়ে তিনি ভগ্নহৃদয়ে বনে পালিয়ে যান। একদিন এক পরিত্যক্ত দুর্গে তিনি
চিন্তায় মগ্ন ছিলেন। এমন সময় তিনি দেখতে পেলেন, একটা মাকড়সা বারবার একটি স্তম্ভের
গায়ে উঠার চেষ্টা করছে,
কিন্তু খানিকটা উঠেই পড়ে যাচ্ছে। ছ বার চেষ্টার পর সপ্তম বারে সে
স্তম্ভগাত্রে উঠতে সমর্থ হলো। সামান্য একটি প্রাণীর এরূপ অদম্য
প্রচেষ্টা এবং সাফল্য লাভের দৃশ্য রবার্ট ব্রুসকে অশেষ প্রেরণা যুগিয়েছিল। তিনি
পুনরায় সৈন্য সংগ্রহ করে শত্রুর হাত থেকে স্বদেশের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার
করেছিলেন।
উপসংহার:
অধ্যবসায়ই মানুষকে পৃথিবীতে স্মরণীয়-বরণীয় করতে পারে। তাই আমাদের হতে হবে
অধ্যবসায়ী। মোটকথা, যারা সংকল্পে অটল, জীবন যাদের
প্রতিশ্রুতিতে বদ্ধ তাদের কাছে অসাধ্য কিছুই নেই। একমাত্র অধ্যবসায়ের গুণেই
জীবন-জিজ্ঞাসা, আত্ম-জিজ্ঞাসা
ও আত্মপ্রত্যয়ী মানুষ নিজের জীবনকে সুষমামণ্ডিত করে দেশ ও জাতির নিকট
স্মরণীয়-বরণীয় হতে পারে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন