সাদামাটা
স্কুল শিক্ষক দীনেশের একমাত্র ছেলে জহর। একটা জল বিশুদ্ধকরণ মেশিন তৈরির কোম্পানীর
এক্সপার্ট টেকনিশিয়ান। কোন বাসায় তাদের কোম্পানীর মেশিনে বিশেষ কোন সমস্যা দেখা
দিলে জহরকে সেখানে পাঠানো হয়। সামান্য উপার্জনে দুই সন্তান আর বাবাকে নিয়ে কোনরকমে
চলে যায় তাদের। দিনশেষে অফিস থেকে ফিরে জহর সাধারণত টিভিতে সিরিয়াল দেখতে বসে যায়।
স্ত্রী শান্তা দুই ছেলে-মেয়েকে সামলে সংসারের রান্না-বান্না ও অন্যান্য কাজ নিয়েই
পড়ে থাকে।
আর
পাঁচটা সাধারণ নিম্নমধ্যবিত্তের মতই সাদাকালো জীবনে হঠাৎই যেন অন্যরকম একটা দোলা
লাগে জহরের। থিয়েটার রোডের এক বাসায় একটা যন্ত্র ঠিক করে যায় সে। কাজ শেষে হঠাৎই
মনে পড়ে এই বিল্ডিং এরই কোন এক ফ্লাটে বাস করে তার মাসতুতো কাকা ও কাকী। কাকা
সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ডাক্তার, আগে তারা বাংলার বাইরে থাকতেন।
দীর্ঘদিন জহরদের সাথে যোগাযোগ নেই। কিছুদিন আগে অন্য এক আত্মীয়ের বাসায় দীনেশের
সাথে তাদের আবার কথা হয়েছিল। সেখান থেকে ফিরে দীনেশ গল্প করেছিলেন তার মাসতুতো
ভাইয়ের। কিছুক্ষণ দ্বিধাদ্বন্ধে ভুগে জহর শেষ পর্যন্ত লিফটম্যানের সাথে কথা বলে
খুঁজে বের করে তার কাকার ফ্লাট।
ভিতরে ঢুকেই বুঝতে পারে
অন্যরকম এক জগতে প্রবেশ করেছে সে। দামী আসবাতে সাজানো-গোছানো ফ্লাটের সবকিছুই
বিস্ময়ের সাথে দেখতে থাকে সে। কাকা-কাকীর সাথে কথা বলে মুগ্ধতা আরো বেড়ে যায় তার।
এত সম্ভ্রান্ত হলেও কথায়, আচরণে কোন অহংকার নেই তাদের। জহরকে
বেশ আপনভাবেই নিয়েছেন তারা। সুদর্শিনী কাকী তাকে অনুরোধ করে মঝে মাঝে সেখানে
বেড়াতে যেতে। কোন এক দুর্নিবার আকর্ষণে নিয়মিত সেখানে যেতে শুরু করে জহর। সেখানে
প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যায় আড্ডা বসে সঙ্গীতের, সাহিত্য
আলোচনার। সুন্দর সুন্দর পোষাকে সংস্কৃতিমনা তরুণ-তরুণীদের আগমন ঘটে সেই সব আড্ডা,
আলোচনায়। এখানেই দেখা হয়ে যায় পুরোনো কলেজ বন্ধু অখিলের সাথে।
ক্রমেই সে উপলব্দি করে যে জীবন সে এতদিন অতিবাহিত করে এসেছে সে জীবনের কোন মূল্যই
নেই। এম.এস.সি শেষ করে আরো ভালো একটা চাকরী করতে না পারার ব্যর্থতা এবার তার সামনে
হয়ে বড় হয়ে দেখা দেয়।
পিএইচডি’র ছাত্রী শ্রেয়ার
স্বাধীন চলাফেরা তাকে অবাক করে দেয়। নিজের ছকবাঁধা জীবন, সংসার,
ছেলে-মেয়ে আর স্ত্রী শান্তাকে নিয়ে নতুন কিছু করার ক্ষীণ ইচ্ছা
জাগতে থাকে মনের ভিতর। অখিলের সাথে পরিচয় আরো ঘনিষ্ঠতা হতে থাকে। কিন্তু মদ্যপ
অখিলকে তার ভালো লাগে না। তাছাড়া সে জানতে পারে অখিলের স্মাগলারদের সাথেও ওঠাবসা
আছে।
একদিন সকালে হঠাৎই তাদের
বাসায় আগমন ঘটে কাকা-কাকীর। অগোছালো সংসারে জহর খুবই সংকোচ বোধ করে তাদের
উপস্থিতিতে। কিন্তু কাকা-কাকীর আন্তরিক আচরণে আবারো মুগ্ধ হয় সে।
কাজের ব্যস্ততায় বেশ কিছুদিন
যাওয়া হয়ে ওঠেনা কাকা-কাকীর ফ্লাটে। হঠাৎই একদিন সংবাদপত্রের মাধ্যমে সে জানতে পারে তার জুলি কাকীকে কে বা কারা খুন
করেছে। প্রচন্ড আহত হয় জহর, এমন কিছু ঘটতে পারে সেকথা ভাবতেই
পারে না সে। ছুটে যায় থিয়েটার রোডের বাড়িতে। সোফার একপাশে মূর্তির মত বসে আছেন
কাকু, মেঝেয় শোয়ানো আছে কাকীমার মৃতদেহ। ভেতরে ভেতরে প্রচন্ড
ভেঙ্গে পড়ে জহর।
কে
খুন করতে পারে? শুরু হয় রহস্য। জলি কাকীমার পরিচিত সকলেই আসে ফ্লাটে,
শুধু অখিল ছাড়া। অখিলের কিছু আচরণের ব্যাখ্যা খুজতে গিয়ে একটি
নির্মম সত্য আবিষ্কার করে জহর। কিন্তু অদ্ভুত এক মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায় জহরের।
অখিলের স্কুল শিক্ষিকা স্ত্রী আর মেয়েরা যখন জানতে পারবে তার বাবা খুনি, তখন তাদের কি অনুভূতি হবে? চারপাশের মানুষগুলো চোখে
আঙুল দিয়ে সবাইকে বলবে ঐ দেখো একজন খুনির স্ত্রী, মেয়ে। এতে
কি প্রতিক্রিয়া হবে তাদের? এসব চিন্তায় মুষড়ে পড়ে জহর।
শেষ
পর্যন্ত অখিলের স্ত্রী আর মেয়েদের কথা চিন্তা করে তাকে পুলিশে ধরিয়ে না দেওয়ার
সিদ্ধান্ত নেয় সে। তার বদলে তাকে কিছু টাকা দিয়ে নিদুদ্দেশে পাঠিয়ে দেয় জহর। অন্য
কোন শহরে,
অন্য কোন পৃথিবীতে যেখান থেকে যেখান থেকে অখিল আর ফিরে আসতে পারবে
না।
“অখিল উঠে গেল ট্যাক্সিতে।
জহর
সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। তার দু’চোখ দিয়ে জল গড়াছে। সেই অশ্রুতে সে তর্পণ
করছে জুলি কাকিমার।
চোখের
জলে ঝাপসা হয়ে গেল শহর, ঝাপসা হয়ে গেল দুনিয়া। সে কিছুতেই সামলাতে
পারছে না নিজেকে।”
অপরাধীকে শাস্তি না দিয়ে ছেড়ে দেওয়া কি ঠিক হল?
উত্তরমুছুনএর ফলে তো অপরাধীরা আরো বেশি অপরাধ করতে উৎসাহিত হবে।