মাত্র সাত মাস দশ দিন গর্ভবাসের পর জন্ম গ্রহণ করলেন কলকাতার
বিখ্যাত রামকোমল সিঙ্গীর একমাত্র পুত্র নবীনকুমার। নবীনকুমারের জন্মের মধ্য দিয়েই সূচনা
হল ১৮৪০ থেকে ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময়কে কেন্দ্র করে ভারতবর্ষ বিশেষকরে কলকাতা
শহরের ইতিহাস আশ্রয়ী উপন্যাস “সেই সময়”। ইংরেজ শাসনের প্রভাবে এই সময়ে কলকাতার বণিক
তথা ধনী শ্রেণির মানুষের মধ্যে যে ভোগ-বিলাসিতা এবং সমাজ সংস্কারের তুমুল জোয়ার এসছিল
তা অত্যন্ত নিখুতভাবে ফুটে উঠেছে এই উপন্যাসের প্রতিটি পাতায়।
যশোরের সাগরদাড়ি গ্রামের বিখ্যাত জমিদার রাজনারায়ন দত্তের পুত্র
মধুসূদন দত্ত যিনি খ্যাতি’র মোহে ধর্ম ত্যাগ করে খ্রিষ্টান হয়েছিলেন, বীরভূমের সামান্য
এক চাকুরীজীবি ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যয়ের পুত্র ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা যিনি ‘বিদ্যাসাগর’
উপাধীতে ভূষিত হয়েছিলেন, বাংলা সাহিত্যের প্রথম ঔপ্যনাসিক “আলালের ঘরের দুলাল” এর লেখক
প্যারীচাঁদ মিত্র, “নীলদর্পন” নাটকের স্রষ্টা দীনবন্ধু মিত্র, হিমালয় পর্বতের চূড়া
এভারেস্টের উচ্চতা সঠিকভাবে নির্ণয়কারী বাঙালী রাখানাথ শিকদার, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের
পিতা মহর্ষী দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রভৃতি ব্যক্তিবর্গ এই উপন্যসের এক একটি চরিত্র। তবে
এইসব বিখ্যাত ব্যক্তিরা কেউই এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র নয়। এ উপন্যাসের মূল নায়ক
একটি বিশেষ সময়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নিজেই উপন্যাসের শেষে লিখেছেন,
“আমার কাহিনীর পটভুমিকা ১৮৪০ থেকে ১৮৭০ সাল। এবং এই কাহিনীর
মূল নায়কের নাম সময়। সময়কে রক্ত মাংসে জীবিত করতে হলে অন্তত একটি প্রতীকি চরিত্র গ্রহন
করতে হয়। নবীনকুমার সেই সময়ের প্রতীক। তার জন্মকাহিনী থেকে তার জীবনের নানা ঘটনার বৈপরীত্য,শেষ
দিকে এক অচেনা যুবতীর মধ্যে মার্তৃরুপ দর্শন এবং অদ্ভুত ধরনের মৃত্যু, সবই যে সেই প্রতীকের
ধারাবাহিকতা,আশা করি তা আর বিশদভাবে বলার প্রয়োজন নেই।প্রয়োজনীয় কথা শুধু এই যে,নবীনকুমারের
আদলে এক অকালপ্রয়াত অসাধারন ঐতিহাসিক যুবকের কিছুটা আদল আছে,অন্য কোনো প্রসিদ্ধ পুরুষের
নাম বা জীবনকাহিনী আমি বদল করিনি....।”
এটি এমন একটি উপন্যাস যা একবার শুরু করে শেষ না হওয়া অবধি অন্য
কাজে মন দেওয়া খুবই কঠিন। ৭০২ পৃষ্টার এই বৃহৎ উপন্যাসে পাঠকের আগ্রহ এভাবে ধরে রাখা
শুধুমাত্র সুনীল গঙ্গোপাধ্যয়ের মত সাহিত্যিকের পক্ষেই সম্ভব।
উপন্যাসে লেখক তৎকালীন সময়ে ধনী হিন্দু পুরুষদের মধ্যে নিজের
স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও বারাঙ্গনাদের প্রতি আসক্ত হওয়ার যে চিত্র তুলে ধরেছেন তা থেকে
বোঝা যায় বিলাসিতার কি অসুস্থ্য স্রোতে তাঁরা গা ভাসিয়েছিলেন। পাশাপাশি লেখক হিন্দু
বিধবাদের অসহায়ত্ত্বকেও উপস্থাপন করেছেন, চিত্রিত করেছেন হিন্দু সমাজ ব্যবস্থার নির্মম
চিত্র।
উপন্যাসে তৎকালীন প্রখ্যাত ইংরেজদের প্রসঙ্গও এসেছে। এসেছে
কলকাতার সবচেয়ে প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বেথুন কলেজের প্রতিষ্ঠাতা বীটন সাহেব, ডেভিড
হেয়ার সাহেব যিনি যথার্থ তৎকালীন হিন্দু সমাজের মধ্য থেকে অশিক্ষা-কূশিক্ষা দূর করতে
উদ্যোগী ভূমিকা রেখেছিলেন তাদের কথাও।
উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে জন্মগ্রহণ করতে দেখা গেছে।
নবীনকুমারের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যবনিকা ঘটেছেন সুদীর্ঘ এই উপন্যাসের।
চমৎকার রিভিউ লিখেছেন। পড়ে খুব ভালো লাগল।
উত্তরমুছুন