আঠারো বছর বয়সটা বৃষ্টির
কাছে এল সুকান্তর কবিতার থেকেও যেন আরও দুঃসহ, আরও
স্পর্ধিত এক চেহারায়। এল অদ্ভুত এক খেলার প্ররোচনা হয়ে। মাকে-না মানার, বাবাকে
যাচাই করার একরোখা এক খেলা। সেই খেলাতেই মাতবে এবার বৃষ্টি। সেই বৃষ্টি, বিবাহবিচ্ছেদের
মামলায় জিতে যাকে নিজের হেফাজতে রাখবার অধিকার অর্জন করে নিয়েছিল মা জয়া রায়। সেই
বৃষ্টি, আলিপুর
জজকোর্টের বারান্দায় দাঁড়িয়ে যার বাবা সুবীর রায় শাসিয়েছিল জয়াকে-দেখে নেব, মেয়ের
আঠারো বছর বয়স হলে কীভাবে তাকে তুমি আটকে রাখতে পারো।
সেই বৃষ্টির আজ আঠারো।
একদিকে আঠারো বছরের বৃষ্টি
অন্যদিকে সম্পর্কছিন্ন দুই নরনারী; একদিকে অনন্য জীবন, অন্যদিকে
নিজেদের মতো করে সেই জীবনের মতো করে সেই জীবনের মানে খুঁজে –ফেরা একদল মানুষ- এক
আশ্চর্য টানাপোড়নের টানটান কাহিনী ‘কাচের দেওয়াল’। যেমন জোরালো কলম সুচিত্রা
ভট্টাচার্যের, তেমনই
বিরলস্বাদ এই উপন্যাস। সাম্প্রতিক হয়েও চিরন্তন।
উপন্যাসের মলাটের পাতায় উপন্যাস সম্পর্কে
এই শেষ কথাটি “সাম্প্রতিক হয়েও চিরন্তন”ই যেন উপন্যাসটির মূল্য সম্পর্কে চূড়ান্ত মূল্যায়ণ।
উপন্যাসের শুরু থেকেই নামকরণের স্বার্থকতা খুঁজতে খুঁজতে শেষ পৃষ্ঠায় গিয়ে যেন দেখা
মিলল তার। উপন্যাসের প্রতিটি সম্পর্কের মাঝে সত্যিই যেন এক অদৃশ্য কাচের দেয়াল দাঁড়িয়ে
আছে। সেই দেয়ালকে টপকে কেউ কারো কাছে যেতে পারছে না। অবশেষে ভাঙ্গল সেই দেয়াল, কিন্তু
তার জন্য যে কঠিন মূল্য দিতে হল বৃষ্টিকে। শান্ত, সুন্দর, নিষ্পাপ বৃষ্টি একটু একটু
করে নিজেকে নষ্ট করতে করতে একসময় আবিষ্কার করল—বেঁচে থাকার জন্য অন্যেরা তার সঙ্গে
কি রকম আচরণ করছে তার ওপরেই নির্ভর করা মানেই নিজের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা, কাপুরুষতা।
বৃষ্টি তখন নিজেকে প্রশ্ন করে, “সে কি একটা শিশু? বাবা হাঁটতে হাঁটতে হাত ছেড়ে দিলে,
সে পড়ে গেল। মা হাত ধরে দাঁড় করিয়ে রাখল, বৃষ্টি দাঁয়ে রইল। যেন নিজের অস্তিত্ব নিয়ন্ত্রণের
কোন ক্ষমতাই গড়ে ওঠেনি তার।”
কিন্তু সেই ক্ষমতা গড়ে দিল একজন। তারই
বয়সী পিতৃহারা সংগ্রামী এক তরুণ সায়নদীপ। নিজের কৃতকর্মের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে
যখন বৃষ্টি জানালো বাবা মায়ের ডিভোর্সের পর বাবা আবার বিয়ে করেছে, একটা ছেলেও হয়েছে,
মার নেহাত হয়ে ওঠেনি তাই। সে তাদের কে? ফালতু।
সায়নদীপ তখন জবাবে বলে, “ও। সেই জন্য
তুমি মদ খাও? ড্রাগ নাও? একটা গ্রোনআপ মেয়ে তার এতটুকু বোধ নেই, কোন মানুষই শুধু স্মৃতি
আঁকড়ে বেঁচে থাকতে পারে না। নিজের মত করে আরেকবার জীবনটা গড়ে তুলতে চাওয়া অন্যায়? অন্যের
মুখের দিকে তাকিয়ে সারা জীবন আপস করে চলতে হলে তার পরিনতি কি হয় জানো? জানো না। আমি
জানি। তুমি তো জান আমার বাবা মারা গেছে, কিভাবে মারা গেছে জানো?”
এবার কঠিন এক সত্য সামনে তুলে ধরে সায়ন।
লোভী আর স্বার্থপর মায়ের চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে সায়নের বাবা ঘুষ নিতে শুরু করেছিলেন,
এরপর ক্যাশ থেকে চুরি। ধরা পড়ে চুরির অপরাধে জেল। তারপর জেল থেকে বের হয়ে ট্রেনে গলা
দিলেন। এরকম বাবার সন্তান হওয়ার সত্ত্বেও সায়ন তো তার মত ড্রাগে আসক্ত হয়নি কিংবা মায়ের
প্রতি সামান্যতম অবজ্ঞাও দেখায়নি কখনও।
সায়নদীপের ভাষায়-“আমি তো সেই পুরনো দুঃখ আঁকড়ে ধরে বসে থাকিনি। একটাই তো জীবন মানুষের। সেটাও যদি অন্যের অপরাধের বিচার করতে গিয়ে, প্রতিশোধ নিতে গিয়ে শেষ করে ফেলি তবে আমার রইল কি? বাবা মার ডিভোর্স হয়ে গেছে বলে তোমার বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে হয়ত
অস্বস্তি হয়েছে,
এড়িয়ে যেতে চাও তাদের আর আমার বাবার অ্যারেস্ট হওয়ার খবর নিউজপেপারে
বেরিয়েছিল। স্কুলে সবাই আমার দিকে আঙুল তুলে দেখাত। যেমন চিড়িয়াখানায় দেখায়
আর কি। একটা বন্ধুও ছিল না আমার। নট এ সিঙ্গল ওয়ান। কাউকে মনের কথা বলতে পারিনি।
নিজের মাকেও না। এ পাড়ায় এসে তাও দু-একজনের সঙ্গে মিশতে পারি, কথা বলতে
পারি। কতটা রাগ হওয়া উচিত ছিল আমার? বাবা মার ওপর?”
সে তুলনায় কি এমন ঘটেছে বৃষ্টির জীবনে
যে তাকে ড্রাগ নেওয়ার অপরাধে পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে থানায়?
অজান্তেই চোখের পাতা ভিজে গেল বৃষ্টির।
এক পশলা বৃষ্টির পর প্রকৃতি যেমন নির্মল, সজীবতায় ভরে ওঠে। বৃষ্টির জীবন তেমনি আবার
সুন্দর এক স্বপ্ন ঘীরে ডানা মেলতে চায় আকাশে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন