‘কাচের
দেয়াল’ শেষ করেই সুচিত্রা ভট্টাচার্যের প্রতি অন্যরকম একটা ভালোলাগা কাজ করছিল।
তাই দেরি না করে ‘কাছের মানুষ’ শুরু করলাম। এর আগে অনেকের মুখেই
‘কাছের মানুষ’ এর প্রতি ভালোলাগার কথা শুনেছি কিন্তু আজ কাল করে করে আর পড়া হয়ে ওঠেনি। তবে মিতিনমাসী সিরিজের বেশ কিছু গল্প অনেক আগেই পড়া ছিল।
শুরু থেকেই
চুম্বকের মত ধরে রেখেছিল কাছের মানুষ। যেন একটা থ্রিলার উপন্যাস
পড়ছি, প্রতি
মুহূর্তে উত্তেজনা। ৬৩৯ পৃষ্ঠার যথেষ্ঠ বড় এই উপন্যাসটি পড়তে গিয়েও আমার মত অধৈর্য্যশীল
মানুষেরও খুব একটা বিরক্তি আসেনি। প্রতিটি চরিত্র এবং পারিপার্শ্বিক
বর্ণনা এমন অসাধারণ দক্ষতার সাথে ফুটে উঠেছে যে পড়তে গিয়ে কখন যে সেই সময়ে চরিত্রগুলোর
মাঝে ডুবে গেছি নিজেও জানি না।
উপন্যাসের প্রধান চরিত্র ইন্দ্রানী। গভীর ব্যক্তিত্বসম্পন্না সুন্দরী
স্কুল শিক্ষিকা পুত্র বাপ্পা, মেয়ে তিরির আর স্বামী আদিত্যকে ঘীরে সংসারের সেই কর্ত্রী।
প্রথম থেকেই চরিত্রগুলোর মধ্যে সম্পর্কের জটিল আবর্ত তৈরি শুরু। ক্রমেই তা জটিল
থেকে জটিলতর হয়েছে। কলেজ জীবনে সহপাঠী শুভাশীষকে গভীরভাবে ভালোবেসে ফেলে ইন্দ্রানী
কিন্তু ভালোবাসাকে তুচ্ছ করে শুভাশীষ দেশোদ্ধারের ডাকে সাড়া দিয়ে চলে যায় ইন্দ্রানীর
আড়ালে। বাবা-মায়ের পছন্দ করা ছেলে আদিত্যর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়ে ইন্দ্রানী।
আদিত্য-ইন্দ্রানীর প্রথম সন্তান জন্মের কিছুদিন পর দৈবক্রমে আবার পরিচয় হয় শুভাশিষের
সাথে। ইন্দ্রানীর পুরোনো প্রেম জেগে ওঠে।
নতুন
করে কাছে পেয়ে শুভাশিষের ডাকে সাড়া দেয় ইন্দ্রানী। জন্ম হয় তিতিরের। পড়ার সময়ে বার বার মনে হয়েছে আমি যেন পুরোনো সংস্কার ছেড়ে
এখনও পুরোপুরি বের হতে পারিনি। ইন্দ্রানী আদিত্য’র স্ত্রী
হয়েও পুরোনো বন্ধু শুভাশিষের সাথে কিভাবে এক বিছানায় গেল- এই চিন্তা যেন মনের মধ্যে খচখচ করেই চলেছিল অবিরত। ইন্দ্রানীর
প্রতি প্রথম থেকে যে শ্রদ্ধা তৈরি হয়েছিল তা যেন এই সংবাদে কাঁচের দেয়ালে ফাটল
তৈরি করে। অবশ্য আমার ধারণা লেখক নিজেই পাঠকের মনে এই ফাঁটল ইচ্ছে করেই তৈরি
করেছেন, তা
না হলে ইন্দ্রানী নিজেই কেন নিজেকে অপরাধী ভেবে অসহায়ত্ব অনুভব করবে?
তবে
একটা ব্যপারে খুব মজা পেয়েছি, আগের উপন্যাস পড়ে এবং এই উপন্যাসে প্রথম থেকে কাহিনী
বিন্যাস বিশ্লেষণ করে এর পরের ঘটান কোন দিকে যেতে পারে সেটা আগে থেকে কল্পনা করে
দেখছি অনেক কিছুই পরের ঘটনার সাথে মিলে গেছে। যেমন মুস্তাফির
সাথে কন্দর্পের পরিচয়ের সাথে সাথেই মনে হয়েছিল সে তাদের বাড়ির দিকে নজর দিচ্ছে।
মধুমিতার প্রসঙ্গ যখনি এসেছিল তখনই মনে হয়েছিল কন্দর্পের সাথে কিছু একটা হতে
যাচ্ছে। তবে অমিলও ঘটেছে, আমার ধারণা ছিল বাপ্পা কখনও জাহাজে যেতে পারবে না।
পড়তে
পড়তে বার বার মনটা ভারি হয়ে যাচ্ছিল, ঘটনার এত উত্থান-পতন। বিষ্ণুপ্রিয়া
আর এনাক্ষী দুজনের সাথে বাপ্পার সম্পর্কের টানাপড়েন। বিষ্ণুপ্রিয়াকেই বেশি আবেগী
মনে হয়েছে।
একেবারে শেষ দিকে কিছুটা একঘেয়েমি লেগেছে। বিশেষ করে আদিত্যকে নিয়ে লেখিকা যা
করছেন। শুধু মনে হচ্ছে এত নিষ্ঠুর কেন লেখিকা? আর পারছি
না! ধৈর্য্যের বাধ যেন ভেঙ্গে যাচ্ছে। রাগ হচ্ছে রঘুবীরের প্রতি। মনে হচ্ছে
আদিত্যদের ১লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে রঘু।
এক
একবার মনে হয়েছে আমি একটা দুখের ট্রেনে উঠে পড়েছি যার
প্রতিটি কামরায় শত শত দুঃখী মানুষ গিজগিজ করছে এবং ট্রেনটা অনন্তকাল ধরে চলছে তো
চলছেই, কখনই
থামবে না। পাঠকের হৃদয় নিঙড়ে সবটুকু সুখ যেন বের করে নিচ্ছেন সুচিত্রা ভট্টাচার্য। মনে হচ্ছে এটাই উনার
লেখার স্টাইল, ‘কাচের
দেয়াল’ পড়তে পড়তেও এক একবার এমন অনুভূতি হয়েছিল। বৃষ্টি, জয়া, সুবির প্রত্যেকে
প্রত্যেকের কত আপন অথচ কত পর। তবে কাচের দেয়াল শেষ হয়েছিল ভুলের সমাপ্তি দিয়ে, আশার আলো
জ্বালিয়ে। ‘কাছের মানুষ’ কিন্তু তেমনভাবে শেষ হয়নি। কেননা এখানে একটার সাথে আরেকটা চরিত্র এমনভাবে যুক্ত একটাকে টানলে
সবগুলোই যে ছিড়ে যাবে।
উপন্যাসটা শেষ
করে মনে হল যেন একটা যুদ্ধ শেষ হল, চারিদিকে
শুধু ধ্বংসস্তুপ, মৃত্যুর
হাহাকার কোথাও শান্তি নেই। বুকের উপরে কে যেন একটা পাথর চেপে ধরেছে। তিতির যখন
জানতে পারল তার প্রকৃত পিতা কে, বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। ইন্দ্রানী করল আত্মহত্যা। যে
সুকান্তকে প্রথম থেকে প্রচন্ড অপছন্দ ছিল আমার মত পাঠকের সে-ই
শেষ মুহূর্তে রক্ষা করল তিতিরকে।
ঘুরেফিরে
শুধু একটা কথাই মনে ভাসছে,
সুচিত্রা ভট্টাচার্য কি বার্তা দিতে চেয়েছেন সমগ্র উপন্যাস জুড়ে ? ছোট একটা
ভুল, সামান্য
অসংযমের পরিনাম কি ভয়ংকর হতে পারে সেটাই কি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন তিনি? কিন্তু
ভুলটা আসলে কি? শুভাষীসের
সাথে পুনরায় দেখা হওয়ার পর ইন্দ্রানী সব
ছেড়ে তার সাথে পালিয়ে গেলনা কেন? এটা তার ভুল না কি গোপন অভিসারের ফলে তিরিরের জন্ম নেওয়াটাই
ভুল? এ
প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে এতে কোন সন্দেহ নেই উপন্যাসের
নামকরণে সুচিত্রা চরম দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। উপন্যাসটি পড়তে পড়তে বার বার মনে
হয়েছে, কে
কার ‘কাছের মানুষ’? এ
যেন অদৃশ্য মুখোশ পরে একে অন্যকে কেবলি ফাঁকি দেওয়ার আদিম প্রচেষ্টা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন