১৯২৯ সালের শীতকালের এক ভোরবেলা হেমকান্ত
চৌধুরির হাত থেকে দড়িসহ বালতি কুয়োর জলে পড়ে যায়। ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরবর্তী বাংলাদেশের
এক জমিদারের জীবনের এই তুচ্ছ ঘটনা দিয়েই দূরবীন উপন্যাসের কাহিনী শুরু। ঘটনা তুচ্ছ
হলেও জমিদার হেমকান্তের কাছে তা এক দার্শনিক চিন্তার জগৎ খুলে দেয়। পয়তাল্লিশ বছর বয়স্ক
হেমকান্তের ধারণা জন্মে তিনি এবার বুড়ো হয়েছেন, কেননা দড়িসহ বালতি পড়ে যাওয়ার মত ঘটনা
তার জীবনে এর পূর্বে ঘটেছে বলে তিনি মনে করতে পারেন না।
ছয় সন্তানের জনক বিপত্মিক এই জমিদারের
মধ্যে জমিদার সুলভ কোন বদ অভ্যাস নেই বরং তিনি কিছুটা দূর্বল চিত্তের এবং সাংসারিক
বিষয়ে উদাসীন। তিনি চিন্তা করতে ভালোবাসেন। প্রতিনিয়ত জন্ম, মৃত্যু, বেঁচে থাকার অর্থ
খুঁজে ফেরেন তিনি। যেকোন বিষয়ে হেমকান্ত আপত
সম্পর্কহীন এক নারীর উপর নির্ভরশীল। রঙ্গময়ী
নামের এই অসাধারণ নারী চরিত্রটি সমগ্র উপন্যাস জুড়ে একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে।
রঙ্গময়ী জমিদার বাড়ির পুরোহিত কন্যা। তার বয়স ত্রিশ দেখতে অসাধারণ সুন্দরী না হলেও
চোখদুটি বড় এবং মাদকতাময়। কিশোরী বয়স থেকেই রঙ্গময়ী হেমকান্তকে মনে মনে স্বামী হিসেবে
বরণ করে বসে আছে এমনি কি সুনয়নী’র সাথে হেমকান্তের বিয়ের পরেও তার অদ্ভুত প্রেমে সামান্যতম
ভাটা পড়েনি।
কিছুদূর পড়ার পর আমার মনে হয়েছে রঙ্গময়ীর
মধ্যে রাজলক্ষ্মী চরিত্রের অনেক সাদৃশ্যতা আছে। সেই বাল্যপ্রেম, যেকোন কঠিন সমস্যায়
হেমকান্ত’র একমাত্র অবলম্বন হয়ে ওঠা এবং পারিপাশ্বিক সমালোচনাকে উপেক্ষা করে হেমকান্তকেই
ধান-জ্ঞান মনে করা যেন সেই ধারণাকেই নির্দেশ করে।
ছোট মেয়ে বিশাখাকে বিয়ে দিতে গিয়ে
অদ্ভুতভাবে হেমকান্ত শেষ পর্যন্ত রঙ্গময়ীকে বিয়ে করতে বাধ্য হয় এবং কাশীতে গিয়ে তার
মৃতু হয়।
দূরবীন উপন্যাসটি দুইটি সময় থেকে বর্ণিত
হয়েছে। ১, ৩, ৫ . . . অর্থাৎ বেজোড় অধ্যায়গুলোকে
বলা হয়েছে হেমকান্ত, রঙ্গময়ী এবং হেমকান্ত’র কনিষ্ঠ পুত্র কৃষ্ণকান্তককে ঘীরে আবর্তিত
কাহিনী। ২, ৪, ৬ . . . অর্থাৎ জোড় অধ্যায়গুলোতে বলা হয়েছে কৃষ্ণকান্ত, পুত্র ধ্রুব
এবং ধ্রুবর স্ত্রী রেমিকে ঘীরে ঘটনাবলী। উভয় সময়েই কৃষ্ণকান্তকে একজন প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন,
দেশপ্রেমী এবং সংগ্রামী মানুষ হিসেবে দেখানো হয়েছে। বিশেষ করে প্রথম ভাগে অর্থাৎ কৃষ্ণকান্ত’র
বাল্যকালকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যে, পাঠক নিঃসন্দেহে কৃষ্ণকান্তকে নায়ক হিসেবে
কল্পনা করতে বাধ্য হবেন।
উপন্যাসের প্রথম অংশ অর্থাৎ হেমকান্ত,
রঙ্গময়ী এবং কৃষ্ণকান্তের কাহিনীই আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে। জীবন সম্পর্কে হেমকান্ত’র
গভীর দার্শনিক চিন্তা পাঠকের মনোজগতে সামান্যতম হলেও প্রভাব ফেলবে বলেই আমার বিশ্বাস।
কাহিনীর অন্য অংশে অর্থাৎ সাম্প্রতিক
সময়ের প্রধান চরিত্র কৃষ্ণকান্ত’র কনিষ্ঠ পুত্র ধ্রুব এবং পুত্রবধূ রেমি। কৃষ্ণকান্ত
অধিকাংশ সময় রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, স্ত্রী-পুত্রকে যথেষ্ঠ সময় দিয়ে পারেন না।
এই অভিমানে মায়ের গায়ে আগুন ধরিয়ে আত্মহত্যার ঘটনা শিশু ধ্রুবর মনে এক গভীর ক্ষতের
সৃষ্টি করে। তার আচরণ হয়ে পড়ে অস্বাভাবিক। কৃষ্ণকান্তকে সে ঘৃণা করে, প্রতি মুহূর্তে
চায় পিতার প্রতিপত্তি ও সামাজিক মর্যাদাকে ধূলোয় মিশিয়ে দিতে। এই চাওয়া থেকেই স্ত্রী
রেমির ভীব্র ভালোবাসাকে সে বার বার প্রত্যাখান করে কেননা রেমিকে কৃষ্ণকান্তই পছন্দ
করে তার সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন। রেমির প্রতি ধ্রুবর এই উদাসীনতা এবং চরম উপেক্ষা যেকোন
পাঠকের হৃদয়কে আহত করতে বাধ্য।
রেমি যেকোন সময়ের পুরুষ পাঠকের কাছেই
প্রিয় চরিত্র হতে বাধ্য। জন্মের সাথে সাথে মা’কে হারানো কৃষ্ণকান্ত পুত্রবধূ রেমি’র
মধ্যে খুজে পেয়েছেন মাতৃত্বের স্বাদ। রেমিও কৃষ্ণকান্তকে বসিয়েছেন আপন পিতা’র চেয়েও
সম্মানের আসনে। ধ্রুবর সাথে সম্পর্কের অনেক সংকটময় মুহূর্তে যখন রেমি ধ্রুবকে ত্যাগ
করার কথা ভেবেছ তখনই কৃষ্ণকান্তর স্নেহ তাকে ভুল করা থেকে বিরত রেখেছে।
তবে শুধুমাত্র ধ্রুবকে আঘাত করতে যখন
রেমি রাজার ফ্লাটে পর্যন্ত চলে যায় সেই মুহূর্তে কেন জানি মনে হয় রেমির মধ্যে এক ধরনের
আত্মঘাতি অস্থিরতা রয়েছে যদিও পরিস্থিতি তাকে রক্ষা করে। এখানে ধ্রুব একটি উক্তি উল্লেখযোগ্য,
“শোন রেমি, শরীরের কোন দোষ হয় না। শরীর তো একটা নিরপেক্ষ জিনিস। মন যেভাবে চালায় সে
সেইভাবে চলে। তোমার শরীরটা কী করেনি সেটা বড় কথা নয়। তোমার মন তো টলেছে। সেটাই আসল
কথা।”
ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়েছে লেখক
ধ্রুব চরিত্রকে প্রকাশ করতে গিয়ে কিছুটা বাড়াবাড়ি করে ফেলেছেন। কারণ যে মেয়েটি তার
বিবাহিত স্ত্রী, মনপ্রাণ দিয়ে তাকে ভালোবাসে তাকেই বার বার প্রত্যাখানই শুধু করেনি
বরং অন্য পুরুষে আসক্ত হতে প্ররোচিত করেছে। এটা সহ্য করা যেকোন স্বাভাবিক চিন্তা-চেতনার
মানুষের পক্ষে অসম্ভব। এ কারণেই হয়তো গুডরিডার্সেও অধিকাংশ রিভিউতে ধ্রুব চরিত্রের
প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করা হয়েছে। নোটনের সাথে শারিরীক সম্পর্ক হওয়ার পর ধ্রুব আবিষ্কার
করে বাইরে সে যতই আধুনিক মানসিকতার হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করুক না কেন আসলে সেও শারিরীক
পবিত্রতায় বিশ্বাসী। এবার সে রেমির কাছে আত্মসমর্পন করে এবং বেঁচে থাকার আশ্রয় খোজে।
দূরবীন শেষ হয়েছে কৃষ্ণকান্ত’র আত্মহত্যার
মধ্য দিয়ে। নোটনের সাথে ধ্রুব’র ঘনিষ্ঠতার কথা যখন কৃষ্ণকান্ত’র কাছে পৌছায় তখন তিনি
প্রচন্ড আঘাত পান, ধ্রুব’র এতটা অধঃপতন হতে পারে তা তার কল্পনায় ছিল না। যেহেতু ধ্রুব’র
সকল অস্বাভাবিক আচরণের একমাত্র কারণ ছিলেন কৃষ্ণকান্ত, মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তাই তিনি
ধ্রুবকে মুক্তি দিয়ে গেলেন। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে ধ্রুবকে লেখা চিঠিতে তিনি হৃদয়ের
সকল ব্যাথা উজাড় করে দেন। চিঠি পড়া শেষে ধ্রুব ফিরে তার সঠিক কক্ষপথে, তার- “বুকের
ভিরতটা মথিত হয়ে একটা ডাক উঠে আসতে চাইছিল-বাবা!”
তিন প্রজন্মকে নিয়ে লেখা শীর্ষেন্দু
মুখোপাধ্যয়ের এই বইটি পড়া শুরু করার পর থেকে শেষ না হওয়া অবধি মনে হয়েছে আমি বোধ হয়
নিজের পৃথিবী ছেড়ে অন্য কোথাও হারিয়ে গেছি। চোখ বন্ধ করলেই মনে হয়েছে হেমকান্তর জমিদার
বাড়ির প্রতিটি ইঞ্চি যেন দেখতে পাচ্ছি, প্রতিটি চরিত্র যেন আমার আশেপাশে আছে এখনি কারো
সাথে দেখা হয়ে যাবে। অনেকদিন পর এমন একটি উপন্যাস পড়লাম যার রেশ সহজে কাটাতে পারব না।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন