শ্রীনাথ, শ্রীনাথের
স্ত্রী তৃষা, তাদের
ছেলে সজল, শ্রীনাথের মেঝভাই দীপনাথ, তাদের বোন বিলু
ও ভগ্নিপতি প্রীতম এবং দীপনাথের বস বোস সাহেব ও তাঁর স্ত্রী মণিদীপা-
সব মিলিয়ে এই হচ্ছে মানবজমিন এর প্রধান চরিত্রসমূহ।
শ্রীনাথ কলকাতায় এক প্রেসে
চাকরি করেন। তিনি কিছুটা উদাসীন প্রকৃতির, ভীরু এবং ব্যক্তিত্বহীন। স্ত্রী, পুত্র কন্যাদের
নিয়ে রতনপুর গ্রামে থাকেন। সংসারে তিনি
উপেক্ষিত। প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন স্ত্রী তৃষাই পরিবারের সর্বময়
কত্রী। শ্রীনাথের দাদা মল্লিনাথ মৃত্যুর আগে
সব সম্পত্তি লিখে দিয়ে গেছেন তৃষার নামে।
তৃষা কোনদিন
তার স্বামীকে ভালোবাসিনী। জীবনে সে একজন পুরুষকেই ভালোবেসেছিল সে হচ্ছে তার ভাশুর মল্লিনাথ।
এমনি কি শ্রীনাথ ও তৃষার একমাত্র পুত্র সজল আসলে মল্লিনাথেরই ঔরসজাত। তৃষা রতনপুর একজন রাণীর মতই আধিপত্য বিস্তার করেছে। লোকজন তাকে দেবী চৌধুরানী বলে অবিহিত করে। তবে একটা পর্যায়ে এসে তৃষা
উপলব্দি করে তার আপনজন বলতে কেউ নেই। এমনিকি তার আপন পুত্র সজলও তাকে ভালোবাসেনা। মল্লিকনাথের
পর আর একজন পুরুষকে সে বন্ধু মনে করে। তারই
প্রিয় দেওর দীপনাথ।
দীপনাথ
কলকাতায় বোস সাহেবের সহযোগী হিসেবে চাকরি করেন ও বোস সাহেবের মাধ্যমে
স্থায়ীভাবে একটি চাকরি পাওয়ার চেষ্টা করছে। বোসের পরিবারের সাথে
চলতে চলতে বোস সাহেবেরই স্ত্রী মণীদীপার সাথে ক্রমেই একটি ঘনিষ্ঠ
সম্পর্কে জড়িয়ে যেতে থাকে।
দীপনাথের
ভগ্নিপতি অর্থাৎ বিলুর স্বামী প্রীতম এক মরণব্যধীতে আক্রন্ত। মানসিক শক্তি দিয়ে সে সুস্থ থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছে। তবে পুরোনো
বন্ধু অরুণের সাথে বিলুর ক্রমেই ঘনিষ্ঠতা প্রীতমের সেই মানসিক শক্তিকে এক সময় ভেঙ্গে
দেয়।
শেষ পর্যন্ত
দেখা যায় দীপনাথ একটি নামী কোম্পানীতে বড় অফিসার হিসেবে যোগদান করে এবং ট্রেনিং এর
জন্য আমেরিকায় যায়। দীপনাথের স্বপ্ন ছিল একটি পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার। আমেরিকায় যাওয়ার
পথে বিমানে বসে সে উপলব্দি করে সে যেন তার স্বপ্নকে ছুতে চলেছে।
উপন্যাসটি পড়ার
সময় এবং বিশেষ করে শেষ করার পর নিজের মধ্যে বেশ হতাশা কাজ করেছে। এর পূর্বে শীর্ষেন্দু
মুখোপাধ্যয়ের যতগুলো বই পড়েছি সেগুলোর সাথে এই উপন্যাসটিকে যেন কিছুতেই মিলাতে পারছিলাম
না। উপন্যাসটির কোন চরিত্রের মধ্যেই চূড়ান্তভাবে নীতি ও আদর্শ খুজে পাইনি। তৃষা এই
উপন্যাসের প্রধান নারী চরিত্র। সে স্বামীকে পুরুষই মনে করে না, ভাশুরকেই জীবনের একমাত্র
প্রেমিক পুরুষের স্থানে বসিয়েছে। স্বামী শ্রীনাথের প্রতি বার উপেক্ষা, অবহেলা, সোমনাথ
ও তার স্ত্রীকে পোষা গুন্ডা দিয়ে মার খাওয়ানো আবার নিজ স্বার্থে রাজনৈতিক নেতাকে বাড়িতে
নিমন্ত্রণ করে ভোজন করানো প্রভৃতি তাকে একটি জঘন্য চরিত্র হিসেবে উপস্থান করেছে। অন্তত
আমার ভালোলাগার তালিকায় এমন কোন চরিত্র স্থান পাওয়ার কথা ভাবতেই পারিনা।
বার বার দীপনাথের
কথা এসেছে এবং ধরে নেওয়া যায় দীপনাথই এই উপন্যাসের নায়ক। দীপনাথ সৎ, বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ
সব মিলিয়ে অনেক গুণের সমন্বয়ে একজন মানুষ। উপন্যাসের গুরুতে তার প্রতি ভালোলাগা তৈরি
হয় কিন্তু একটা পর্যায়ে গিয়ে দেখা যায় তার মধ্যে চারিত্রিক দৃঢ়তা বলে কিছু নেই। হঠাৎ
করে বিথী নামের সম্পূর্ণ অপরিচিত চল্লিশোর্ধ কামোত্তোজেক এক নারীর সাথে সে শারিরীক
সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে এবং সেটা একবার নয় একাধিকবার। অথচ মনিদীপাকে সে বার বার প্রত্যখ্যান
করেছে যে কিনা সত্যিকার অর্থেই দীপনাথকে ভালোবেসেছিল। আমার মনে হয়েছে দীপনাথকে নিয়ে
লেখক নিজেই কিছুটা বিভ্রান্ত ছিলেন।
প্রীতমের প্রতি
বিলুর গভীর ভালোবাসা ছিল কিন্তু যখনই জানতে পারল অরূণ বিয়ে করতে যাচ্ছে তখনই তার সাথে
দৈহিক সম্পর্কে জড়িয়ে তাকে নিজের করে রাখার চেষ্টা- এই চরিত্রটিকেও ম্লান করে দেয়।
শ্রীনাথ সম্পর্কে
তো বলার কিছুই নেই। সে স্ত্রীর উপর প্রতিশোধ নিতে কলকাতার পতিতালয়ে গিয়ে মাতাল হয়ে
সুখ খোঁজে এবং গ্রামের মানুষের কাছে নিজের স্ত্রীর কুৎসা রটিয়ে আনন্দ পায়। বরং শ্রীনাথের
পুত্র সজলের মাঝে খুঁজে পাওয়া যায় একটি সুস্পষ্ট আদর্শকে।
সব মিলিয়ে উপন্যাসটি
পড়ার সময় বার বার মনে হয়েছে বর্তমান সময়ে ভারতীয় বিভিন্ন বাংলা টিভি সিরিয়ালে পরকীয়ার
ব্যপারটিকে যে বিরক্তিকরভাবে উপস্থাপন করা হয় তার সূচনা আসলে অনেক আগেই বাংলা সাহিত্যের
হাত ধরে শুরু হয়েছে। অবশ্য লেখক উপন্যাসটিতে সমাজের কিছু অপ্রিয় বাস্তবতা এবং তার পরিনতি
কি- সেটাই তুলে ধরতে চেয়েছেন।
সেদিক দিয়ে বলা
যায় উপন্যাসটি সফল। কিন্তু আমি সব সময় ইতিবাচক চিন্তায় বিশ্বাসী বলেই হয়তো উপন্যাসটিকে
ভালোবাসতে পারিনি। উপন্যাসটিতে যদি অন্তত একটি ইতিবাচক চরিত্র থাকত যার মধ্যে হতাশা
নেই, বিষন্নতা নেই যে সর্বদা আলোর অভিমুখী তাহলে হয়তো এত খারাপ লাগত না।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন