সালটা ২০০১। নবম শ্রেণির ছাত্র হিসেবে
বছরের শুরুতে পড়ার চাপ নেই বললেই চলে এমন একটা সময়ে স্কুল লাইব্রেরি থেকে একদিন নিয়ে
এলাম “পথের পাঁচালি”। এমন একটা কালজয়ী উপন্যাস পড়ার ক্ষেত্রে বয়সটা অপরিনত ছিল কিনা
জানিনা, শুধু এটুকু মনে আছে বইটা পড়তে পড়তে এক একবার মনে হয়েছিল পৃথিবীর সবচেয়ে পাষণ্ড
মানুষটির নাম বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যয়। কিশোর বয়সের আবেগী মন বার বার প্রশ্ন করেছিল
এত নির্মম, নিষ্ঠুর কিভাবে হতে পারেন একটা মানুষ?
কখনও ইন্দির ঠাকরন, কখনও সর্বজয়া,
কখনও অপু-দূর্গার কষ্টের বর্ণনা পড়ে চোখের জলে ঝাপসা হয়েছিল বইয়ের পাতা। শেষ পর্যন্ত
পড়ার পর প্রতিজ্ঞা করেছিলাম জীবনে আর কখনও “পথের পাঁচালী” পড়ব না। এত যে কষ্ট দিল,
এ যে চোখের জল ঝরাল, আশ্চর্যের বিষয় কেউ যখন জানতে চায় আমার প্রিয় উপন্যাস কোনটি, মুহূর্তেই
চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটি নাম, “পথের পাঁচালী”। অনেক অনেকদিন পরে আজ প্রায় ৩৫ বছর
বয়সে এসে আরো একবার পড়ে ফেললাম এই অপূর্ব সৃষ্টিকে। কিন্তু অনুভূতির বিশেষ কোন পরিবর্তন
হল না। সম্ভাবত সমগ্র সাহিত্য জীবনে যদি আর কোন লেখা নাও লিখতেন তবুও শুধুমাত্র “পথের
পাঁচালী”র জন্যই অমর হয়ে থাকতেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যয়।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যয়ের রচনায়
বার বার প্রকৃতির বর্ণনা অত্যন্ত নিখুতভাবে উঠে এসেছে। “পথের পাঁচালী” তার ব্যতিক্রম
তো নয়ই বরং প্রকৃতি যেন এখানে একেবারে জীবন্ত হয়ে পাঠকের চোখে প্রবেশ করে। চিরায়ত গ্রাম
বাংলার নদী-মাঠ আর ঝোপ-জঙ্গলের মাঝে অপু আর দূর্গা নামের দুই কিশোর-কিশোরী ভাইবোনের
দুরন্তপনা দেখতে দেখতে পাঠক কখন যে হারিয়ে যাবেন নিশ্চিন্দিপুর নামে তৎকালীন বংলাদেশের
একটা অখ্যাত গ্রামে বুঝতেই পারবেন না।
সবকিছু ছাপিয়ে এই উপন্যাসে উঠে এসেছে
হরিহর নামে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণের জীবন সংগ্রামের এক নিবিড় চিত্র। উপন্যাসের শুরুতে
দৃষ্টি কেড়ে নেয় ইন্দির ঠাকরুন নামে এক অসহায় বিধবা বৃদ্ধের করুণ মৃত্যু। ইন্দির ঠাকরুন
হরিহরের দূর সম্পর্কে আত্মীয়া। উঠতে বসতে প্রতি মুহূর্তে তাকে বুঝিয়ে দেওয়া হয় যে সে
একজন আশ্রিত। বার বার একবুক অভিমান নিয়ে বেরিয়ে পড়েন ইন্দির ঠাকরুণ আবার ফিরে আসেন
কাঙালের মত। শেষবার তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে সর্বজয়া যেন এক নিষ্ঠুরতার পরিচয় দেয়।
চরম হতাশা আর অসহায়ত্ব নিয়ে মন্দির প্রাঙ্গণে ইন্দির ঠাকরুনের মৃত্যু পাঠকের মনকে গভীরভাবে
নাড়া দেয়। এ পর্যায়ে সর্বজয়াকে যথেষ্ট নির্দয় মনে হয় কিন্তু সচেতন পাঠকের বুঝতে অসুবিধা
হয় না সীমাহীন দারিদ্রতা মানুষের মহৎ গুণকে নষ্ট করে দেয়। অবশ্য উপন্যাসের শেষ দিয়ে
সর্বজয়া নিজেই যখন শহরের এক ধনী পরিবারে আশ্রিতা তখন তার মন অনুতপ্ত হয় ইন্দির ঠাক্রণের
প্রতি।
“সেই তাহার বুড়ি ঠাকুরঝি ইন্দির ঠাক্রণ,
সেই ছেঁড়া কাপড় গেরো দিয়া পরা, ভাঙা পাথরে আমড়া ভাতে ভাত, তুচ্ছ একটা নোনাফলের জন্য
কত অপমান, কেউ পোঁছে না, কেউ মানে না, দুপুর বেলায়, সেই বাড়ী হইতে বিদায় করিয়া দেওয়া,
পথে পড়িয়া সেই দীন মৃত্যু….
সর্বজয়ার অশ্রু বাধা মানিল না।
মানুষের অন্তর-বেদনা মৃত্যুর পরপারে
পৌঁছায় কিনা সর্বজয়া জানে না, তবু সে আজ বার বার মনে মনে ক্ষমা চাহিয়া অপরিণত বয়সের
অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করিতে চাহিল।”
উপন্যাসের প্রতি পরতে পরতে এমনিভাবে
ব্যক্ত করা হয়েছে দারিদ্রের করাল গ্রাসে আহত আত্মমর্যাদা আবার পরমুহূর্তে নতুন স্বপ্নের
বীজবোনা। অপু-দূর্গার ক্ষুদ্র মানসপটেও দরিদ্রতার নিষ্টুর থাবা বুঝিয়ে দেয় পৃথিবীতে
মানুষ আসলে কতটা অসহায়। এত অসহায়তা আর হতাশার পাশাপাশি মন কেড়ে দুটি কিশোর-কিশোরীর
অসাধারণ অনুসন্ধিৎসু মন।
হার চুরির অপরাধে দূর্গার মার খাওয়া
এবং শেষ পর্যন্ত তার অসহায় মৃত্যু পাঠকের বুকের ভিরতটা দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে খান খান করে
দেয়। তবুও জীবন থেমে থাকে না। আবার স্বপ্ন দেখে সর্বজয়া, হরিহরের সাথে পাড়ি জমায় কাশিতে।
সেখানেও জ্বরে মৃত্যু ঘটে হরিহরের। সব হারিয়ে একমাত্র হৃদয়ের পুতুলি অপুকে নিয়ে এক
গৃহস্থের বাড়িতে কাজের লোক হয়ে যায় সর্বজয়া। জীবন যেন প্রতি পদে পদের তাকে শুধু বঞ্চিতই
করেছে।
আসলে “পথের পাঁচালী” নিয়ে কথা শেষ
করা করা অসম্ভব। প্রতি লাইনেই এক অন্যরকম অনুভূতি। জীবনকে একেবারে কাছ থেকে নিবিড়ভাবে
প্রতক্ষ করা। তবে এই উপন্যসে জীবন সম্পর্কে বেশ কিছু দার্শনিক উক্তি আমাকে বিশেষভাবে
মুগ্ধ করেছে। যেমন শিশু অপুর কলকল হাসি, অর্থহীন আনন্দ প্রভৃতির বর্নার সময় লেখক বলছেন-
“মা ছেলেকে স্নেহ দিয়া মানুষ করিয়া
তোলে, যুগে যুগে মায়ের গৌরবগাথা তাই সকল জনমনের বার্তায় বাক্ত। কিন্তু শিশু যা মাকে
দেয়, আই কি কম? সে নিঃস্ব আসে বটে, কিন্তু তার মন-কাড়িয়া লওয়া হাসি, শৈশবতারল্য, চাঁদ
ছানিয়াগড়া মুখ, আধ আধ আবোল-তাবোল বকুনির দাম কে দেয়? ওই তার ঐশ্বর্য, ওরই বদলে সে সেবা
নেয়, রিক্ত ভিক্ষুদের মত নেয় না।”
কিংবা প্রথম ট্রেন দেখার জন্য অপুর
ব্যকুলতা। দীর্ঘসময় অপেক্ষা করতে হবে বলে বাবার ট্রেন না দেখেই চলে যেতে বলা এবং জল-ভরা চোখে বাবার
পিছনে পিছনে অগ্রসর হওয়া।
“তুমি চলিয়া যাইতেছ…. তুমি কিছুই জানো
না, পথের ধারে তোমার চোখে কি পড়িতে পারে, তোমার ডাগর নবীন চোখ বিশ্বগ্রাসী ক্ষুধায়
চারিদিককে গিলিতে গিলিতে চলিয়াছে—নিজের আনন্দের এ হিসাবে তুমিও একজন দেশ-আবিষ্কারক।
অচেনার আনন্দকে পাইতে হইলে পৃথিবী ঘুরিয়া বেড়াইতে হইবে, তাহার মানে নাই। আমি যেখানে
আর কখনো যাই নাই, আজ নতুন পা দিলাম, যে নদীর জলে নতুন স্নান করিলাম, যে গ্রামের হাওয়ায়
শরীর জুড়াইল, আমার আগে সেখানে কেহ আসিয়াছিল কিনা, তাহাতে আমার কি আসে যায়? আমার অনুভূতিতে
তাহা যে অনাবিষ্কৃত দেশ। আমি আজ সর্বপ্রথম মন, বুদ্ধি, হৃদয় দিয়া উহার নবীনতাকে আস্বাদ
করিলাম যে!”
কি অসাধারণ অনুভূতি! কি অপূর্ব হৃদয়াবেগ!
এরকম অসংখ্য লাইন অনাযাসে তুলে আনা যায় “পথের পাঁচালি” থেকে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন