মঙ্গলবার, ৯ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

ইন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যয়

 


একটা দীর্ঘ সময় ধরে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যয়ই ছিলেন আমার জীবনের সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যক্তিত্বের নাম। আসলে এত সহজ ভাষায় গল্প বলার দক্ষতা এবং গ্রাম্য জীবনের প্রাত্যহিক তুচ্ছ ঘটনাকে  চমৎকারভাবে সাহিত্যে ফুটিয়ে তোলা শুধুমাত্র তার পক্ষেই সম্ভব ছিল।

শ্রীকান্ত নিঃসন্দেহে তার জীবনের সেরা সৃষ্টি এবং বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের দাবী রাখে। কালজয়ী এই উপন্যাসটি পড়তে শুরু করে প্রথম দিকে প্রায় প্রত্যেক পাঠক স্বয়ং শ্রীকান্তের চেয়েও যে চরিত্রটিকে পাঠক বেশি ভালবেসে ফেলেন তার নাম ইন্দ্রনাথ। কিন্তু অবাক হতে হয় শরৎচন্দ্র হঠাৎ করেই এই চরিত্রটিকে কাহিনী থেকে একেবারে উধাও করে দেন। যখন প্রথমবার ‘শ্রীকান্ত’ পড়েছিলাম তখন থেকেই ইন্দ্রনাথ চরিত্রটি আমাকে প্রচন্ডভাবে আকর্ষণ করেছিল। বিশেষ করে উপন্যাসটির একটি জায়গায় গঙ্গায় ভেসে আসা একটি শিশুর মৃতদেহ নিয়ে  জন্তু-জানোয়ার টানাটানির বর্ণনা আছে। এ দৃশ্য দেখে অকুতোভয় ইন্দ্রনাথের চোখেও জল এসে গিয়েছিল। শ্রীকান্তকে ইন্দ্রনাথ মৃতদেহটি ধরার জন্য বললে শ্রীকান্ত সেটি ধরতে বা ছুঁতে যখন দ্বিধাবোধ করছিল তখন ইন্দ্রনাথ শ্রীকান্তকে তখন বলেছিল, ‘আরে এ যে মড়া,  মড়ার আবার জাত কী? এই যেমন আমাদের ডিঙিটা-এর কী জাত আছে? আমগাছ, জামগাছ যে কাঠেরই তৈরি হোক-এখন ডিঙি ছাড়া একে কেউ বলবে না। এও তেমনি।’ কিন্তু তারপর ইন্দ্রনাথের হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়ায় প্রচন্ড ব্যথিত হয়েছিলাম। আরেকটু সাহিত্যের ভাষায় বলতে গেলে হৃদয়ে বুঝি বা রক্তক্ষরণ হয়েছিল !! হ্যা, এতটাই ভালবেসেছিলাম ইন্দ্রনাথ চরিত্রটিকে। পরবর্তীতে অনেকের মুখে শুনেছি বা ইন্টারনেটে পড়েছি “শ্রীকান্ত” নাকি শরৎচন্দ্র চট্টপাধ্যয়ের নিজের জীবনের ছায়া অবলম্বনে রচিত। তাই যদি হয় তাহলে এই ইন্দ্রনাথ চরিত্রটি সম্পর্কেও আরো কিছু না কিছু জানা যাওয়ার কথা, কিন্তু দুঃখের বিষয় অনেক খুজেও কোথাও এ ব্যপারে কোন তথ্য পাইনি। ‘বইয়ের হাটে’ অনেক গুণীজন আছেন, যদি কেউ এ ব্যপারে আরো জেনে থাকেন তাহলে দয়া করে লেখা আকারে বা কমেন্টে জানাবেন। জানিনা অনেকের কাছে ব্যপারটি তুচ্ছ মনে হবে কিনা কিন্তু যদি ইন্দ্রনাথ সম্পর্কে নতুন কিছু জানতে পারি আমার এই তৃষিত আত্মাটা কিছুটা হলেও শান্তি পাবে। শেষ করব শরৎচন্দ্র চট্টপাধ্যয়ের জীবনের একটি চমৎকার ঘটনা দিয়ে।

ছোটবেলায় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যয় ছিলেন খুব দুরন্ত। তার দুরন্তপনায় সহপাঠী এবং প্রতিবেশীরা তটস্থ থাকতেন। বাড়ির লোকেরাও এ কারণে বিরক্ত ছিলেন। নানা রকম অদ্ভুত খেয়াল ছিল তার। কখনো জঙ্গলে ঘুরে নানা রকম ফড়িং ধরে কাঠের বাক্সে ভরে রাখতেন। কখনও বা গাছে চড়া এবং গাছে বসেই ঘুমাতেন। গভীর রাতে শ্মশানে যাওয়া বা পোড়ো বাড়িতে (যে বাড়িকে লোকে ভূতের বাড়ি বলে) যেতে তার মোটেই ভয় করতো না। এমন ডানপিটে ছেলে যে বাড়ি মাথায় করে রাখবে সে তো জানা কথাই। তার এই দুরন্তপনার কথা বাবাকে বলতে গেলে তিনি ঠাকুরদাদার আফিমের কৌটা লুকিয়ে রাখতেন।

দুরন্তপনার মধ্যেও তার যে স্নেহপ্রবণ মন ছিল ছেলেবেলার একটি ঘটনায় তার প্রমাণ পাওয়া যায়।  শরৎচন্দ্র  কৈশরে একদিন রাস্তায় দেখতে পেলেন, চারটি কুকুরছানা কুঁইকুঁই করছে। পথচারীরা দেখে যে যার কাজে চলে যাচ্ছে। কেবল তিনটি  ছোট ছেলে কুকুরছানাগুলোর কাছে দাঁড়িয়ে আছে এবং নিজেরা কী সব বলাবলি করছে। শরৎচন্দ্র কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বুঝলেন হয়তোবা ছানাগুলোর মা ওদের জন্য খাদ্য অন্বেষণে গিয়ে কোনো বিপদে পড়েছে। তিনি ছেলে তিনটিকে বললেন, ‘তোরা ওর মাকে চিনিস?’

ওরা বলল, ‘হ্যাঁ চিনি। দেখতে কালো।’

শরৎচন্দ্র ছেলেদের বললেন, ‘তাহলে তোরা আশপাশে খুঁজে দেখ। পেলে আমাকে জানাবি।’

শরৎচন্দ্র ভাবলেন এভাবে তো কুকুরছানাগুলো না খেয়ে মারা যাবে। তিনি দুটি ছানা নিজে বুকে তুলে নিলেন এবং অপর দুটি ছানা ছেলেদের সহযোগিতায় বাড়িতে নিয়ে গেলেন। তারপর ভৃত্য ভোলাকে দিয়ে দুধ আনিয়ে নিজেই চামচে তুলে ছানাগুলোকে খাওয়ালেন। তিন দিন পর হঠাৎ খবর মিললো, একটি পোড়ো বাড়ির শুকনো পাতকূপের মধ্যে মা কুকুরটি পড়ে আছে। ভৃত্য ভোলাকে সঙ্গে নিয়ে দড়িতে একটি ঝুড়ি বেঁধে তার মধ্যে পাউরুটি ও বিস্কুট দিয়ে কূপের মধ্যে নামিয়ে দিলেন। ক্ষুধার্থ কুকুর খাবারের গন্ধ পেয়ে ঝুড়ির মধ্যে উঠলে দুজন মিলে কৌশলে আস্তে আস্তে উপরে উঠিয়ে আনলেন। এমন ঘটনা স্নেহশীল শরৎচন্দ্রের জীবনে অনেকবারই ঘটেছে।

এই ঘটনা থেকে একটা জিনিষ আন্দাজ করা যায়, শ্রীকান্ত উপন্যাসের শুরুতে ইন্দ্রনাথকেই শরৎচন্দ্র নিজের ছোটবেলার ছায়া দিয়েছিলেন কিন্তু পরবর্তীতে তিনি ইন্দ্রনাথ কে বাদ দিয়ে শ্রীকান্তকেই নিজের ছায়ায় এগিয়ে নিয়ে যান। এটা সম্পূর্ণ আমার নিজস্ব অভিমত।

1 টি মন্তব্য:

  1. ইন্দ্রনাথ চরিত্রটি রাজেন্দ্রনাথ মজুমদারের ছায়ায় রচিত

    উত্তরমুছুন