“আমার একটা মজার ব্যপার আছে। আমি যা
ই লেখালিখি না কেন, আমি গোটা জিনিষটা ভাবতে পারি না। থিম করতে পারি না। আগে থেকে কোন
প্লট তৈরি করতে পারি না। এটা আমার একটা অদ্ভুত ধরনের কি বলব আমার একটা ব্যর্থতা যে
আমি গোটা উপন্যাসটাকে আগে ছক করে ভেবে নিয়ে লিখতে পারি না। কখনই পারিনি। তাহলে আমি
কি করি? আমি একটা লাইন ভাবি। যেকোন একটা লাইন। একটা ভালো লাইন। মনে চলে এলো, সে লাইনটা
লিখি, লিখে অনেকক্ষণ বসে থাকি। সেই লাইনটা থেকেই যেনো ঐ যে একটা তুলো থেকে যেমন আস্তে
আস্তে তকলুকে সুতো কেটে বের করে ঠিক সেই রকমভাবে আমি তেমনি আমার একটা লাইন থেকে বাদবাকী
উপন্যাসটা তৈরি হতে থাকে।”
গত ২০ জুন প্রভা খৈতান
ফাউন্ডেশন ও আখর কলকাতার যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এক সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠানে এভাবেই নিজের
লেখালেখি সম্পর্কে বলছিলেন পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত উপন্যাসিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যয়। অনুষ্ঠানটি “প্রভা
খৈতান ফাউন্ডেশন” এর ফেসবুক পেজে লাইভ করা হয়েছিল। লাইভ চলাকালীন অনুষ্ঠানটি দেখার
সৌভাগ্য হয়নি তবে পরবর্তীতে আনন্দবাজার পত্রিকার অনলাইন সংস্করণ থেকে জানতে পেরে রেকর্ডকৃত
অনুষ্ঠানটি শোনার পর এত ভাল লাগল যে এ সম্পর্কে কিছু কথা লিখে না রাখাটা অনুচিত মনে
হল। তাছাড়া অনেকদিন হয়ে গেল ব্লগে কিছু লেখা হয় না। পারিবারিক টেনশন এবং অন্যান্য ব্যস্ততার
কারণে অনেকদিন কোন বইও পড়া হয় না। যা হোক আবার লেখায় ফিরে যাই।
করোনা নিয়ে লেখালেখি
প্রসঙ্গে তিনি বলেন ‘যে কোনও ঘটনার অভিঘাতে সঙ্গে সঙ্গে লিখলে,
তা সাহিত্য হয়ে ওঠার সম্ভাবনা কম থাকে, তা হয়ে
যায় অনেকটা সংবাদপত্রের লেখার মতো’। তাই এই মুহূর্তে তিনি করোনা নিয়ে কোন লেখার
কথা ভাবছেন না।
লেখক হওয়া প্রসঙ্গে
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যয় বলেন, “লেখক হওয়ার কোন আশা আমার ছিলই না বা সেরকম আকাঙ্খাও ছিল
না। আমার বেলেবেলায় আমাদের বাড়িটা ছিল পড়ুয়া বাড়ি। আমার দাদু, ঠাকুরমা, বাবা, মা সবাই
খুব পড়ুয়া। তারা খুব বই পড়তেন এবং আমাদের বাড়িতে বইয়ের অভাব কখনই ছিল না। কিন্তু সে
আমলে পুস্তক সমৃদ্ধ বাড়ি খুব কম পাওয়া যেত। কিন্তু আমাদের বাড়িতে বই ছিল প্রচুর। একটা
অদ্ভুত সুবিধে ছিল- আমাকে কেউ কিছু করতে বারণ করত না। এটা বড়দের বই, এটা তুমি বুঝবে
না- এমন কথা কেউ বলত না। ফলে আমি অকাতরে বই পড়তাম। খুব ছেলেবেলায় যখন আমার সাত-আট বছর
বয়স তখনই বঙ্কিমের বই পড়তাম। আমার মাথাটা খারাপ করে দিয়েছিলেন বঙ্কিম। প্রথম কথা, ঐ
অদ্ভুত সমাস সমৃদ্ধ, তৎসম শব্দ বহুল একটা রাজকীয় ভাষা। রাজকীয় তো বটেই এবং তাতে একটা
দ্রুপদী ঝংকার আছে। এইগুলো পড়তে পড়তে আমি সম্মোহিত হয়ে গিয়েছিলাম। সব বুঝতাম না কিন্তু
ঐ ভাষাটা আমাকে এমন আকর্ষণ করত এমন সম্মোহন করত যে আমার মনে হল লিখতে হলে এরকম লেখা
লিখতে হবে।”
ছোটবেলায় তিনি
খুব একটা ভাল ছেলে ছিলেন না। প্রচন্ড মারপিঠ করতেন। স্কুলে প্রচন্ড বেত খেতেন, বহুবার
শিক্ষকরা তাকে ক্লাস থেকে বের করে দিয়েছিলেন।
কখনও তাকে বেঞ্চের উপরে দাঁড় করিয়ে রাখা হতো। তবে ঐ বয়সেও তিনি প্রচুর পড়তেন। বনফুল,
তারাশঙ্কর, বিভুতিভূষণ এসব তার তখনই পড়া হয়ে গেছে।
মায়ের প্রতি
তার প্রচন্ড শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ছিল। মা যখন রান্না করতেন তখন তিনি মায়ের পাশে বসে গল্প
করতেন আর এভাবেই রান্ন করা শিখে যান শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যয়। প্রচন্ড দুষ্টু ছিলেন বলে
মা তাকে দুপুরে রবীন্দ্রনাথের কবিতা শুনিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখতেন। এভাবেই রবীন্দ্রনাথ
তার মধ্যে প্রবেশ করতে থাকেন। এই সামগ্রিক ব্যপারটা তার কাছে যাদুদন্ডের মত কাজ করত।
আলোচনায় উঠে
আসে, গোয়েন্দা
গল্প আর থ্রিলারের মধ্যে পার্থক্যের কথা, কেন তাঁর গোয়েন্দা একজন পুলিশ, তাও
জানালেন।
অধিকাংশ লেখা
কেন মিলনান্তক এ প্রশ্নের জবাবে শীর্ষেন্দু বলেন, “আমার ঠাকুর এটা চেয়েছিলেন। (প্রসঙ্গত
উল্লেখ্য তিনি ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের একজন ভক্ত) একটা জিনিষ উনি(ঠাকুর) বলেছেন যে,
তুমি যদি বিয়োগান্তক লেখো তাহলে ওটা পড়তে পড়তে মানুষের মন খারাপ হয়ে যাবে। মানুষ তো
জীবনে বাঁচতে চায় আর বাঁচার জন্য, বেঁচে থাকার জন্য একটা push চায়। সামনের দিকে এটিয়ে
যাওয়ার একটা গতি চায়।”
শীর্ষেন্দু তার
লেখার মধ্য দিয়ে সেই বেঁচে থাকার শক্তিটা যোগাতে চান। পাঠক যেন উপন্যাস শেষ করে এমনটা
মনে না করে, “হা রে ! এই জীবন। তাহলে বেঁচে থেকে কি লাভ! লেখক যেন এরকম মনে না করে।
যেন এরকম মনে হয় যে- হে নাবিক, হে নাবিক জীবন অপরিমেয়মান।”
এই কথাগুলো ব্যক্তিগতভাবে
আমাকে মুগ্ধ করেছে।
এছাড়া অদ্ভুতুড়ে
সিরিজ সম্পর্কেও অনেক কথা হয়েছে এই সাক্ষাৎকারে। কথা হয়েছে ভূত প্রসঙ্গে। থ্রিলার এবং
গয়েন্দা গল্পের পার্থক্য নিয়ে কথা হয়েছে। সব মিলিয়ে সাক্ষাৎকারটি সত্যি অসাধারণ লেগেছে।
সাক্ষাৎকারটি
এখানে।
চমৎকার
উত্তরমুছুন