Advertisement

Responsive Advertisement

প্রথম প্রতিশ্রুতি-আশাপূর্ণা দেবী

 


কোন এক গ্রীষ্মের তপ্ত দুপুরে গোবিন্দ দাদার চেম্বারে বসে ছিলাম। কথা প্রসঙ্গে দাদা বলেছিলেন, “আশাপূর্ণা দেবী কখনও স্কুলে না গিয়েও এত বড় মাপের একজন সাহিত্যিক হয়েছেন . . . . ” কিংবা আরো কি কি কথা যার সবটা আজ আর মনে নেই। এমন না যে আশাপূর্ণা নামটা ঐ প্রথম শুনেছিলাম, কিন্তু তাকে নিয়ে আগ্রহ ওখান থেকেই। কয়েকদিন আগে তাকে নিয়ে ইন্টারনেট সার্চ করতে গিয়ে জানতে পারলাম তার ট্রিলজি উপন্যাস “প্রথম প্রতিশ্রুতি, সুবর্ণলতা এবং বকুলকথা” সম্পর্কে। ব্যাস- পিডিএড ডাউনলোড করে নিয়ে শুরু করলাম পড়া।

উপন্যাসের সময়কাল ঊনিশ শতকের শেষ এবং বিশ শতকের শুরু। ঐ সময়ে বাংলার সমাজ ব্যবস্থা বিশেষ করে সমাজে মেয়েদের অবস্থান এ উপন্যাসের প্রেক্ষাপট। লেখিকা তৎকালীন সময়ে মেয়েদের অন্তপুরকে সুনিপুনভাবে তুলে ধরেছেন। বইটি পড়তে পড়তে ডুবে যেতে হয় সেই সময়ের গ্রামীন সমাজে। অবাক হয়ে দেখতে হয় নানান সামাজিক প্রথা আর কুসংস্কারের যাতাকলে কিভাবে পিষে যাচ্ছে নারীরা। অবশ্য চরম পরিতাপের বিষয় হচ্ছে তারা যে যাতাকলে পিষে যাচ্ছে, এই খবরটাই তারা জানে না। ধর্মীয় প্রথা আর কুসংস্কারের নিপীড়নে তিলে তিলে নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার মাঝেই যেন তারা নিজেদের স্বার্থক মনে করে। আর সত্যবতীর মত মেয়েরা যখন মুক্তি পেতে চায় তখন তার সামনে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় মেয়েরাই। আসলে হাজার হাজার বছর ধরে পুরুষ শাসিত সমাজে থেকে থেকে মেয়েরা তাদের জগৎটাকেই সংকুচিত করে ফেলেছে। তাই কেউ যখন মুক্তি পেতে চায় তার সেই চাওয়াটাকে তাদের কাছে অন্যায়, অস্বাভাবিক মনে হয়। সত্যবতীর সামনে তাই প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় তার পিসি মোক্ষদা, ঠাকুরমা কাশীশ্বরী, শ্বাশুড়ী এলোকেশীর মত সম্পর্কে আপন মানুষগুলোই। অপরদিকে আশ্রয় মেলে বাবা তথা একজন পুরুষের কাছে। লেখিকা নিজেই বলেছেন, “সত্যবতীর মা ঠাকুরমা জেঠী পিসি এঁটে উঠতে পারে না ওকে। পারে না হয়তো সত্যবতীর যথেচ্ছাচারের ওপর ওর বাপের কিছুটা প্রশ্রয় আছে বলে।” সত্যবতী নিজেও মনে করে তার ভেতরের তেজদীপ্ত কণ্ঠস্বর, ন্যায় অন্যায়ের প্রভেদ করার ক্ষমতা ইত্যাদি তার বাবার কাছ থেকেই পাওয়া। বাবাকে সে দেবতা-ই মনে করে। 

কিন্তু বাবা রামকালী কী মনে করেন? হ্যা রামকালীও বুঝতে পারেন মেয়ে তার সম্পূর্ণ আলাদা। সমাজের কান্ডারীদের একজন হয়েও নিজের মেয়ের ছোট ছোট প্রশ্নগুলোর কাছে থমকে যান তিনি। লগ্নভ্রষ্টের হাত থেকে বন্ধুর মেয়ের বাঁচাতে ভাইপো রাসুর ঘরে স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও তাকে বিয়ে করতে বাধ্য করলে ঐটুকু সত্যবতী তার তীব্র প্রতিবাদ করে। রামকালী যখন বলেন, “সতীনকে ‘কাঁটা’ না ভেবে বোন ভাবা যায় না?” সত্য তখন পাল্টা প্রশ্ন করে, “সবাইকে ভালোবেসে থাকাই যদি ধম্ম হয়, তাহলে ‘সেজুতি’ বত্তটি (ব্রতটি) করতে হয় কেন?” সেজুতি ব্রতর কথা শুনে রামকালীর চিন্তা চেতনায়ও ধাক্কা লাগে।  

সবচেয়ে অবাক হতে হয় যখন দেখা যায় সত্য’র শ্বশুরবাড়ী থেকে তাকে নিতে এলে বাবা রামকালী বিয়ের সময়ের শর্তানুযায়ী ১২ বছররের আগে সত্যকে শ্বশুরবাড়িতে পাঠাতে রাজী হয় না তখন সত্য বাবাকে বলে, “ভেতরে নয় যাচ্ছি, কিন্তু মনের ভেতরে তোলপাড় হচ্ছে বাবা। রঘুর মৃত্যু আজ আমার দিষ্টি খুলে দিয়েছে। ভগবানের রাজ্যেই যখন সময় বাঁধা নেই, নিয়ম নেই, তখন মানুষের থাকবে কি ? এই আজ আমাকে পরের ঘরে পাঠাতে বুক ফাটছে তোমার, এক্ষুনি যদি মিত্যু এসে দাঁড়ায় দিতে তো হবে তার হাতে তুলে ?” সহসা আঁচলের কোণ তুলে চোখটা মুছে নেয় সত্য, তার পর ভারী গলায় বলে, “তখন তো বলতে পারবে না- ‘এখনও সময় আসে নি, নিয়ম নেই ?’ ও শ্বশুরবাড়ি আর যমের বাড়ি দুই যখন সমতুল্য, তখন আর মনে খেদ রেখো না। পাঠিয়ে দিয়ে মনে করো সত্য মরে গেছে।”

অসাধারণ! অসাধারণ!! কিন্তু আমার অবাক লাগে সেই যুগে ৯ বছর বয়সের একজন মেয়ে কিভাবে এই দার্শনিক তত্ত্ব উপলব্দি করলো? স্বয়ং রামকালী যে চিন্তার গভীরতা দেখে পাথর হয়ে গেলেন। এরপর শ্বশুরবাড়ি গিয়েও পদে পদে সত্যবতী তার বুদ্ধিদীপ্তির স্বাক্ষর রাখে। চুল বাঁধতে গিয়ে শ্বাশুড়ী তার পিঠে কিল মারলে সত্যও প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠে। শ্বশুর মশায়ের সুশ্চরিত্রের কথা জানতে পেরে তাকে প্রণাম করতে অস্বীকার করে আবার সেই শ্বশুর যখন অসুস্থ্য হয়ে পড়ে কলকাতার সুখের ঘর-কন্যা ছেড়ে দীর্ঘ ২টি বছর গ্রামের বাড়িতে থেকে শ্বশুরের সেবা করে শুধুমাত্র কর্তব্যজ্ঞানে। 

শুধুমাত্র একটি শক্তিশালী নারী চরিত্র সৃষ্টির কারণে নয় গল্প বলার দক্ষতা বিবেচনায়ও আশাপূর্ণা দেবী অসাধারণ। উপন্যাসের শেষ দিকে যখন গ্রামের বাড়িতে সত্যবতীর অগোচরে সুবর্ণলতার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে এবং সত্যবতীকে নিয়ে সদু কোন একটা দূর্ঘটনার আশংকা করে গ্রামে যাত্রা করছে- সেই সময়ের বর্ণনা এত নিখুত এত নাটকীয় যে পড়তে পড়তে যেকোন পাঠকের প্রেশার বেড়ে যাবে বলেই আমার ধারণা। আর সর্বশেষ যখন সত্যবতী সবকিছু ছেড়ে সকলের অনুরোধ উপেক্ষা করে কাশীবাসী হওয়ার প্রতিজ্ঞা নিয়ে গ্রাম বের হয়ে যায় তখন বিষন্নতার গভীর সাগরে ডুবে যেতে হয় পাঠককে। 

শেষ মুহূর্তে একবার মনে হয় সারাটা জীবন লড়াই করে এগিয়ে যাওয়া সত্যবতী কি হেরে গেলো? যে সুবর্ণকে ঘীরে সত্যবতীর চূড়ান্ত বিজয়ের স্বপ্ন দেখেছিল তার এই পরিনতি কিভাবে মেনে নিল সত্যবতী? বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরেও তো সুবর্ণকে নিজের কাছে রেখে গড়ে তুলতে পারতো সত্যবতী, তবে কেন করল না? এর উত্তর সত্যবতী নিজেই দিয়েছেন সদুর এক প্রশ্নের উত্তরে, “সুবর্ণ যদি মানুষ হবার মালমশলা নিয়ে জন্মে থাকে ঠাকুরঝি, হবে মানুষ ।.... নিজের জোরেই হবে। তার মাকে বুঝবে। নইলে ওর বাপের মতন ভাবতে বসবে, মা নিষ্ঠুর! সে ভাবনা বন্ধ করি এ উপায় আমার হাতে নেই!”

উপন্যাসটি পড়তে পড়তে হারিয়ে গিয়েছিলাম একেবারে সেই সময়ে। সত্যবতী, নবকুমার, রামকালী, এলোকেশীদের মাঝ থেকে একরাশ বিষন্নতা নিয়ে ধাতস্থ হতে পুরো একটা দিন লেগেছে আমার। এখন পড়তে হবে বাকী দুই খন্ড।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ